চলতি বছরে দেশজুড়ে দ্বিতীয় বারের মতো জেঁকে বসেছে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। কনকনে শীত আর ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক। আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবারও দেশের ১০টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে শৈত্যপ্রবাহ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘন কুয়াশায় সবচেয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে কৃষি খাতে। ঘন কুয়াশার কারণে শীতকালীন অন্য ফসলের পাশাপাশি বোরো ধানের বীজতলা নিয়ে কৃষকের কপালে পড়েছে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ।
চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ হানা দেয়। উত্তরের হিমেল বাতাসের সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো কুয়াশাও ঝরছে। দু'দিন আগে গুঁড়ি গুঁডি বৃষ্টি ঝরেছে দিনাজপুরে। তীব্র শীত ও ঘনকুয়াশায় শীতকালীন বিভিন্ন সবজি আলু, পেঁয়াজ, টমেটো ক্ষেত নিয়ে কৃষকদের চিন্তা-উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। অনেক স্থানে আগাম জাতের আমের মুকুলও ঝরে যাচ্ছে। আলুতে দেখা দিয়েছে লেট বস্নাইট রোগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তীব্র শীতে কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হচ্ছে বোরোর বীজতলা। অনেক এলাকায় বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চারার গোড়া বা পাতা পচা রোগ এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে বীজতলা দুর্বল হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন চাষিরা। সূর্যের আলো ঠিকমতো না পাওয়ায় বোরোর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে ছত্রাকবাহী বস্নাস্ট রোগের সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাবে। এতে করে আলু ও টমেটোর অনেক ক্ষতি হবে। অধিকাংশ কৃষক আলুক্ষেত রক্ষায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। লেট বস্নাইট বা পাতা মোড়ানো রোগাক্রান্ত আলুক্ষেতে মেটারিল, মেটাটাফ ও ফোরাম বালাইনাশক সমন্বিতভাবে স্প্রে করেছেন কৃষকরা। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ফসল উৎপাদনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা কৃষকদের।
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা ঘন ঘন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ঋতুও বদলে যাচ্ছে। কখনো তীব্র শীত, কখনো ঘন কুয়াশা আবার কখনো শৈত্যপ্রবাহও দেখা দিচ্ছে। এতে শিম, লাউ, করলা, মিষ্টিকুমড়া, আলু, শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষিক্ষেত নষ্ট হচ্ছে। ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ফলন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অতি ঠান্ডায় আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ইত্যাদি ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাবে। জেঁকে বসা কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় বয়ে চলা শৈত্যপ্রবাহ ও কুয়াশায় বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে আবাদের সময় ধানের চারার সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন চাষিরা। শুক্রবার বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন বোরোর অনেক বীজতলা ইতোমধ্যে হলুদ রঙ ধারণ করেছে। ধানের চারাও নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কৃষকেরা বীজতলা রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখছেন। এতে ক্ষতি কিছুটা কম হবে বলে ধারণা তাদের।
জলবায়ু সুবিচার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইয়ুথনেট গেস্নাবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ, সিসার ব্যবহার, পলিথিন দূষণ- নানাভাবে প্রকৃতিকে আমরা ধ্বংস করে দিচ্ছি, যার কারণে আমাদের কৃষিক্ষেত্রও ব্যাপক ক্ষতির মুখে।'
মাগুরার শালিখা উপজেলার কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, 'এক মণ ধানের বীজ দিয়ে বীজতলা তৈরি করেছি। আবহাওয়া ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশার কারণে পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখা হয়েছে। কিছুটা নষ্ট হলেও পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখায় রক্ষা পাচ্ছি। দিনে সামান্য সূর্যের দেখা মিললে পলিথিন খুলে রাখা হয়। আবারও বিকালে ঢেকে রাখা হয়। কয়েকদিন ঢেকে রাখা হলে চারা গজিয়ে যাবে। তখন আর সমস্যা হবে না। এলাকার অনেকেই এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। এবার পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করব।' দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় বোরো ধানের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে বোরো ধানের আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা। বোরো বীজতলা বিবর্ণ রূপ নিয়েছে। চাষিদের নানা পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।
জীবননগর উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নে বোরো আবাদ করতে প্রায় ৩শ' ৯৭ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। ঘন কুয়াশা ও শীতের তীব্রতায় এসব বীজতলার অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। সবুজ বীজতলা এখন ফ্যাকাশে, হলদেটে, লালচে ও পচে নষ্ট হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।
উপজেলার কোথাও কোথাও ধানের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই কুয়াশা ও শীতে পচে গেছে। অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে পলিথিনের ব্যবহার ও সেচ দিয়েও রক্ষা করা যাচ্ছে না বীজতলা। এখন বেশি দামে ধানের চারা কিনে ধান রোপণ করা ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না চাষিরা। এ কারণে বোরো আবাদ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন প্রান্তিক কৃষকেরা।
উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের বোরো চাষি জাহিদ হাসান বলেন, 'অতিরিক্ত ঘন কুয়াশা ও শীতের কারণে তাদের বেশির ভাগ বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর সময় নেই পুনরায় বীজতলা করে আবাদ করার। বেশি দামে চারা কিনে আবাদ করা ছাড়া কোনো পথ দেখছেন না তিনি। তিনি আরও বলেন তীব্র শীতে ও কুয়াশায় শুধু আমারই নয় সব এলাকাই বীজতলা তৈরি করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।'
জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, 'তীব্র শীতে ও ঘন কুয়াশায় বীজতলা নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আবহাওয়া খুব প্রতিকূল নয়। দ্রম্নত শৈত্যপ্রবাহ ও কুয়াশা কেটে সূর্যের আলো ছড়ালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে, বীজতলায় ৩/৫ সে.মি. পানি রেখে এবং কমু্যলাস জাতীয় প্রতিষেধক ভালোভাবে মিশিয়ে বীজতলায় স্প্রে করে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।'