গণ-অভু্যত্থানের শহীদরা জাতীয় সম্পদ, জাতীয় বীর; তাদের মাথার ওপর শ্রদ্ধায় তুলে রাখতে চাই বলে মন্তব্য করে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সবাইকে চাঁদাবাজি, দখলদারি থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মামলা বাণিজ্য করা থেকে বিরত থাকুন। যারা এসব করছেন, তাদের বিনয়ের সাথে বলি এগুলো বন্ধ করেন। তবে যদি আমাদের এই বিনয়ী অনুরোধ কেউ না শোনেন, তাহলে তাদের আমরা বলছি, আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের হাজী মুহাম্মদ মহসীন সরকারি উ"চবিদ্যালয় মাঠে (ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান) কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
শফিকুর রহমান বলেন, 'রাজশাহী একটি শিানগরী। ৫ তারিখের পরে আশা করি রাজশাহীতে কোনো চাঁদাবাজি হয়নি। এখানকার মানুষ ভদ্র, বিনয়ী, সৎ, কেউ চাঁদাবাজি করে না। ঠিক না?' তার বক্তব্যের জবাবে কর্মীরা বলে ওঠেন, 'করে করে, চাঁদাবাজি করে।'
জামায়াতের আমির বলেন, 'এখানেও চাঁদাবাজি হয়, ফুটপাত, হাটবাজার, বালুমহাল, জলমহাল, বিভিন্ন যানবাহনের স্ট্যান্ড- সব কটিতে দখলদারি হয়? তাহলে আমাদের শহীদের রক্তের প্রতি এটা কী ধরনের ভালোবাসা, সম্মান। মেহেরবানি করে এই কাজ করবেন না। আমাদের শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে, মানবতা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। আমাদের সন্তানেরা এত এত জীবন কেন দিল, পঙ্গু কেন হলো? তারা চেয়েছে, সমাজ থেকে সব ধরনের দুঃশাসন ও দুর্নীতির কবর রচনা হোক।'
শফিকুর রহমান বলেন, 'আমাদের জীবন্ত সন্তানেরা, যারা শহীদ হওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে নেমেছিল, তারা অন্তরে বড় কষ্ট পাবে। তবে এই বিনয়ী অনুরোধ যারা না মানবেন, তাদের জেনে থাকা উচিত, আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়নি। আমাদের সন্তানেরা এখনো স্স্নোগান দি"েছন, "আবু সাঈদ মু", শেষ হয়নি যুদ্ধ।" এই লড়াই চলবে যতণ না এই জমিনে ইনসাফ কায়েম না হবে।'
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত শুনিয়ে জামায়াতের আমির বলেন, 'বাংলাদেশে শতকরা ৯১ শতাংশ মুসলিম-অধু্যষিত দেশ। এর মানে এই নয়, মুসলমানরা ছাড়া এ দেশে আর কেউ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না, কেউ এ দেশে সম্মানের সঙ্গে থাকতে পারবে না, নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারবে না। অথচ ইসলাম সমস্ত মানবতার জন্য সব অধিকারের একমাত্র গ্যারান্টি। বর্তমানে দুনিয়ায় বিভিন্ন ধরনের মতবাদ চালু আছে। কোথাও সমাজতন্ত্র, কোথাও ধর্মনিরপেতা, পুঁজিবাদ, কোথাও আছে ফ্যাসিবাদ। এগুলো সব মানুষের গড়া।'
শফিকুর রহমান আরও বলেন, 'আমাদের অপরাধ, আমরা কেন বললাম, সব মতার মালিক একমাত্র আলস্নাহ তায়ালা। সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক আলস্নাহ। বিগত সরকার এই অপরাধে নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের নিবন্ধন কেড়ে নিয়েছে। তারা আলস্নাহর সার্বভৌমত্ব মানে না। তারা নিজেদেরই সার্বভৌম মনে করেছিল। সার্বভৌম মানে সর্বময় মতার মালিক। তো এত মতার মালিক দেশ ছেড়ে পালালেন কেন? সেই মতার দাপটে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করতেন। আপনাদের পলায়ন, পরাজয়ী এটা প্রমাণ করেছে, সর্বময় মতার একমাত্র মালিক আলস্নাহ। মতা ও ইজ্জত দেওয়ার মালিক তিনি, কেড়ে নেওয়ার মালিকও তিনি। যারা সম্মানিত মানুষকে অপমানিত করবে, আলস্নাহ তাদের সম্মান ও রাজত্ব দুটোই কেড়ে নেন।'
জামায়াতের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে দলটির আমির বলেন, 'সাড়ে ১৫ বছর খুন, গুম করে ওদের পিপাসা নিবারণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২৪-এর পয়লা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই সময়টায় তারা সারা দেশে মহাতান্ডব চালিয়েছে। কী চেয়েছিল আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানেরা। কী এমন ছিল তাদের দাবি। তারা গদি ধরে টান দেননি। তারা বলেছিল, কোটা রাখেন, তবে যুক্তিসংগত সংস্কার করে। সহ্য হলো না মুগর বাহিনীকে ঢুকিয়ে দিল। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ছেলেদের তো পেটালোই, কলিজার টুকরা মেয়েদেরও পেটানো হলো। ফায়ার ওপেন করল। গুলি করা হলো। এরা যেন মানুষ নয়। পশু শিকার গোশত খাবে, এমন মনমানসিকতা। কতজন আদম সন্তানকে দুনিয়া ছাড়া করেছে, কেউ হিসাব দিতে পারবে না। আমরা যেখানেই শহীদের খবর পেয়েছি, ছুটে গিয়েছি। কিন্' সবার কাছে যেতে পারিনি। কারণ, সবার খোঁজ পাওয়া যায়নি। যারা রক্ত দিয়ে আজকের এই পরিবেশ দিয়ে গেছেন, তাদের কাছে আমরা সারা জাতি ঋণী ও কৃতজ্ঞ।'
শহীদদের কোনো দলীয় পরিচয় নয় উলেস্নখ করে শফিকুর রহমান বলেন, 'সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, আপনাদের দলের কয়জন শহীদ হয়েছেন? আমি বলেছি, যারা শহীদ হয়েছেন, আমরা তাদের দলের মানুষ। যারা শহীদ হয়েছেন, তারা সবাই আমাদের দলের মানুষ। জামায়াতে ইসলামী হিসেবে আমাদের দল নয়, মানবজাতি হিসেবে আমাদের দল। তাদের কোনো দলীয় পরিচয়ে আমরা সংকীর্ণ পরিসরে নামাতে চাই না। তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ, জাতীয় বীর। তাদের মাথার ওপর শ্রদ্ধায় তুলে রাখতে চাই।'
এর আগে সকাল ৯টার পর মাদ্রাসা মাঠে কর্মী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহীর শহীদ সাকিব আনজুমের বাবা সাইদুল হক।
দীর্ঘ ১৫ বছর পর রাজশাহীতে বড় পরিসরে জামায়াতের এ কর্মী সম্মেলন হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন মহানগর জামায়াতের আমির মো. কেরামত আলী। সম্মেলন পরিচালনা করেন মহানগরের সেক্রেটারি এমাজ উদ্দিন মন্ডল ও সহকারি সেক্রেটারি শাহাদত হোসেন এবং জেলা সেক্রেটারি গোলাম মুর্ত"জা ও সহকারি সেক্রেটারি নুরুজ্জামান লিটন।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সহকারি সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্য শাহাবুদ্দিন, নুরুল ইসলাম বুলবুল, মোবারক হোসাইন, রাজশাহী অঞ্চল পরিচালক অধ্য মো. সাহাবুদ্দিন, জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক আব্দুল খালেক প্রমুখ।