নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, গুম, খুন ও হত্যায় জড়িতরা যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কেননা আমরা অতীতের কারচুপি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি চাই না। নির্বাচনী অঙ্গনকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে হবে।
মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) টক-এ অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যারা দেড় হাজার মানুষ হত্যা, গুম ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তারা আবার দেশ শাসন করুক তা অধিকাংশ মানুষ চায় না। গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা করেছে, যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড করেছে, তারা যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে, সেই সুপারিশ নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। তবে কাউকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা চাই যারা অন্যায় করেছে, তারা যেন বিচারের আওতায় আসে।
আরএফইডির সভাপতি একরামুল হক সায়েমের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবীরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আয়োজক সংগঠনের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাচনি অঙ্গন ও রাজনৈতিক পরিচ্ছন্নতার জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করার কথা বলেন বদিউল আলম মজুমদার। যারা গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধী, ফেরারি আসামি, দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে ফেলায় ভূমিকা পালন করেছে, তারা যেন নির্বাচনি অঙ্গন থেকে বিতাড়িত হয়-সেই চেষ্টা কমিশনের প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
১৫ জানুয়ারি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে ১৫০টি সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা কাউকে জোর করে বা অন্যায় করে বা অযাচিতভাবে কাউকে দূরে রাখার চেষ্টা করছি না। যারা অপরাধ করেছে, শাস্তি পেয়েছে বা প্রাথমিকভাবে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে, তাদের নির্বাচনি ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখার সুপারিশ করেছি। আশা করি সরকার এসব সুপারিশ গ্রহণ করবে।' বদিউল আলম বলেন, 'আদালতে বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এমন কেউ যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সে সুপারিশ করা হয়েছে। ফেরারি, কারাগারে অন্তরীন ছাড়া অন্যরা যেন সশরীরে মনোনয়ন জমা দেয়। (যারা আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে) খুনের মতো গুরুতর অপরাধ করেছে; জনগণ চায় না তারা ক্ষমতায় আসুক।'
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যাতে সদস্যদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে তা বিবেচনায় ও কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সদস্য বাছাই প্রক্রিয়ায় যেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধী স্থান না পায় সেজন্য দলগুলোকে দায়বদ্ধ ও স্বচ্ছ হতে হবে।
তিনি আরো বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়বদ্ধ হতে হবে, আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছ হতে হবে। সদস্যদের কাছ থেকে নেওয়া ফি, অনুদান আমরা নির্ধারণ করে দিয়েছি; দলের ব্যয় ইসিতে দেওয়ার পর তা প্রকাশ করতে হবে। অপরাধে জড়িতদেরকে যেন রাজনৈতিক দলের সদস্য না করে। রাজনৈতিক অঙ্গনও পরিচ্ছন্ন করার সুপারিশ দিয়েছি।'
ইসির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, প্রার্থী চূড়ান্ত, হলফনামা যাচাই-বাছাইেএবং আরও সঠিকভাবে দেওয়া, সুষ্ঠু অর্থবহ নির্বাচন করায় কমিশনকে শক্তিশালী করারও সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বদিউল আলম বলেন, 'নির্বাচন হওয়ার পর নির্বাচন সঠিক হয়েছে কি না, এটা সার্টিফাই করবে নির্বাচন কমিশন।' এছাড়া ৪০ শতাংশের নিচে ভোট পড়লে পুনর্র্নিবাচন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, ইসির হাতে এনআইডি সেবা রাখা, দলের নিবন্ধন নবায়ন, বিদেশি শাখা বন্ধ, নতুন দলের নিবন্ধন সহজ করার বিষয়েও সুপারিশ রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাস্তবায়ন, পরবর্তী সংসদের জন্য অপেক্ষা
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'কমিশনের প্রতিবেদনে দেই ধরনের সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। কতগুলো ক্ষেত্রে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে, যেগুলোর জন্য পরবর্তী সংসদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেসব বিষয়ে জাতীয় সনদ তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। রাজনৈতিক ঐকমত্য করে সনদ স্বাক্ষর করবে। যেগুলোর সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন নেই, নির্বাচনের জন্য দরকার, সেগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব। আমরা যেটা বলেছি মোটা দাগে- যেগুলোতে সংবিধান সংস্কার লাগবে, সংবিধান পরিবর্তন লাগবে সেগুলো নির্বাচনের আগে করা প্রায় অসম্ভব; এটা তো করা সম্ভব হবে না। এগুলো পরে করতে হবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ আইন কানুন পরিবর্তন করা; এগুলো সংশোধন করা সম্ভব। এগুলো নির্ভর করবে সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলের আলোচনার ওপর।'
এক যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল, ১৭ ডিসেম্বর তার কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট।
এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'আমরা বলছি ভবিষ্যতের কথা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন আসবে, আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে আর বিশৃঙ্খলা থাকবে না। নির্বাচনি ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে। চার মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব হবে।'
কমিশন প্রধানের ভাষ্য, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন একই তফসিলে করার কথা- এগুলো জাজমেন্টের প্রশ্ন। ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করেন তিনি।
বদিউল আলম বলেন, 'চার মাসের মধ্যে পরিস্থিতির যদি উন্নতি ঘটে, অতীতের অসঙ্গতি দূর হবে, তখন চার মাসের মধ্যে হয়ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে হয়ত দুটো নির্বাচন করা সম্ভব। তৎকালীন এটিএম শামসুল হুদা কমিশন জাতীয় নির্বাচন করার পরপরই স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে ভোট করায় কী অসুবিধা হয় জানেন।'
পুরো প্রতিবেদন জমা দিতে আরও এক মাস
সোমবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়িয়ে ১৫ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, 'আমরা তো একটা সুপারিশ জমা দিয়েছি, একটা ড্রাফট জমা দিয়েছি। এটাকে আরও পরিশীলিত করে..কিছু পরিবর্তন করতে হবে। পুনরায় এডিট করে এ মাসের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা।'