রোববার, ০৪ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

সারাদেশে সরস্বতী পূজা উদযাপিত

যাযাদি ডেস্ক
  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সারাদেশে সরস্বতী পূজা উদযাপিত
সোমবার সারাদেশে সাড়ম্বরে সরস্বতী পূজা উদযাপিত হয়েছে। ছবিটি রাজধানীর আফতাবনগর থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

দেবীর কাছে পরিশীলিত বিদ্যা-বুদ্ধির প্রার্থনা জানিয়ে, বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সোমবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী পূজা সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছে। পূজা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মন্দির ও বাড়িতে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি স্থাপন করে হাতেখড়ি, পুষ্পাঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও আরতি প্রদান করে আনন্দে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থী ও পুণ্যার্থীরা। বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বন্দনায় ঢাকঢোল, কাঁসর, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ।

বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর কৃপা-লাভের আশায় প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ হল

মাঠে আলাদা আলাদা পূজামন্ডপ তৈরি করেন। বিভিন্ন থিমের আলোকে এবারও সেখানে ৭০টি মন্ডপে অনুষ্ঠিত হয় পূজা। এছাড়া রোকেয়া হল, কবি সুফিয়া কামাল হল, শামসুন্নাহার হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলে পূজা ও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সবমিলিয়ে সরস্বতী পূজায় জগন্নাথ হল যেন সেজে উঠেছিল অপরূপ রূপে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতীক। দেবীর একহাতে পুস্তক, আর অন্য হাতে বীণা। এজন্য তাকে 'বীণাপাণি' বলা হয়। তার বাহন সাদা রাজহাঁস। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সাদা রাজহাঁসে চেপে দেবী ধরায় আসেন। মর্ত্যলোকে ভক্তরা অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে কল্যাণময়ী দেবীর চরণে পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করেন।

সোমবার সকাল ৮টায় জগন্নাথ হলে বাণী অর্চনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পুরোহিত 'সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমল লোচনে/বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যংদেহী নমোহস্তুতে' মন্ত্রপাঠ করে দেবীর আশীর্বাদ কামনা করেন। এরপর ভক্তরা দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষ সেখানে সরস্বতীর আরাধনা করেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও।

ঢাকার মিরপুর থেকে ছেলে সুজয় সরকারকে হাতেখড়ি দিতে জগন্নাথ হলে আসা কৌশিক সরকার বলেন, 'আমার সন্তান যেন বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়, সেই প্রার্থনা করেছি দেবী সরস্বতীর কাছে। যে জ্ঞান মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে, দেশের জন্য কাজ করতে পারে, সেই জ্ঞানের প্রার্থনা করেছি।'

মেয়ে বিশাখা পালকে জগন্নাথ হলে এনে হাতেখড়ি দেন উত্তরা থেকে আসা বিমল পাল। তিনি বলেন, 'মা সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা করছি, আমার মেয়ে যেন বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়।'

জগন্নাথ হলের পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি জানান 'সরস্বতী পূজায় আমরা সব সময়ই বিদ্যা দেবীর কাছে বিদ্যা অর্জনের প্রার্থনা করি। সেই বিদ্যাটা হবে পরিশীলিত বিদ্যা, অসাড় বিদ্যা নয়, যেটা বিশ্বের কাজে লাগবে।'

তার ভাষ্যে- 'বাংলাদেশকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য যে জ্ঞান দরকার, সেই বিদ্যা যেন আমরা লাভ করতে পারি।'

শাঁখারীবাজার থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা অসীম রায় বলেন, 'একসঙ্গে অনেক পূজা হওয়ার কারণে আমরা প্রতিবছর এখানে ঘুরতে আসি। খুব ভালো লাগছে সবগুলো পূজা দেখে। বিকালের দিকে যাই জগন্নাথ হলের পূজা দেখতে।'

এদিকে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর ৩৭ মন্ডপে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছরের মতো এবারও একটি মন্ডপে বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর পূজার পৌরহিত্য করেছেন এক নারী পুরোহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সমাদৃতা ভৌমিকের পরিচালনায় বাণী অর্চনা, আরতি ও ভক্তদের পুষ্পাঞ্জলিতে সরস্বতীর আরাধনা করছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা। আর এর মাধ্যমে সরস্বতীপূজায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো নারী পুরোহিত দ্বিতীয়বার পূজা পরিচালনা করলেন।

হিন্দু ধর্মে নারীরা পূজার আনুষঙ্গিক কাজ এগিয়ে যুগিয়ে দিলেও পৌরহিত্যের কাজে সাধারণত ব্রাহ্মণ পুরুষদেরই দেখা যায়। সমাদৃতা ভৌমিকের ভাষ্য- সনাতন শাস্ত্রমতে কোথাও বলা নেই পৌরহিত্যের কাজ কেবল পুরষের দখলে।

তিনি বলেন, 'শাস্ত্রমতে কোথাও বলা নেই যে নারী পুরোহিত পৌরোহিত্য করতে পারবে না। তারপরেও নারীরা পৌরহিত্য করতে উৎসাহ পায় না। তাদের এই জড়তা কাটাতে দ্বিতীয়বারের মতো আমার এই প্রয়াস।'

প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ছাড়া অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে পূজা উদযাপন করছেন। সেই হিসাবে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩টি বিভাগ; দুটি ইনস্টিটিউট, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল এবং চারুকলা অনুষদের তিনটি বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পূজা উপলক্ষে আলপনা ও আলোকসজ্জায় রঙিন হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। শান্ত চত্বর, শহীদ সাজিদ একাডেমিক ভবনের নিচতলা, বিজ্ঞান অনুষদ চত্বর, কলাভবন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে নিজ নিজ বিভাগের মন্ডপ সাজিয়ে দিনভর পূর্জা-অর্চনায় মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।

সরস্বতী পূজার মাধ্যমে জ্ঞানসমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তিনি বলেন, 'এবারের সরস্বতী পূজা আমাদের সমাজেও বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে আসুক।'

ঢাকার রমনা কালীমন্দির প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সচিবালয় পূজা উদযাপন ও কল্যাণ পরিষদ আয়োজিত সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বাণী অর্চনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, 'সরস্বতী পূজা বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। আমরা আশা করি, এবারের সরস্বতী পূজা আমাদের সমাজেও বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে আসুক। সরস্বতী দেবী বিদ্যার দেবী, জ্ঞানের দেবী, শিল্পকলার দেবী। সরস্বতী পূজা করা মানে জ্ঞানের পূজা করা, শিল্পকলার পূজা করা এবং জ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চার মাধ্যমে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠে, মানবিক মানুষ হয়ে উঠে। সুতরাং সরস্বতী পূজা করা মানে আমাদের এ মূল্যবোধগুলোকে জ্ঞান এবং মানবিক মূল্যবোধগুলোকে ওপরে তুলে ধরতে এবং এর মাধ্যমেই আমরা একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। সরস্বতী পূজায় এটাই আমাদের কামনা।'

সংগঠনের সভাপতি জ্ঞান রঞ্জন পালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ কুমার মহোত্তম ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনুপ কুমার বাড়েই।

এর আগে ঢাকায় অফিসার্স ক্লাব প্রাঙ্গণে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বাণী অর্চনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য, মঙ্গলালোক স্মরণিকা উন্মোচন, মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলন এবং জুলাই বিপস্নবে শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে চেক হস্তান্তর করেন উপদেষ্টা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে