শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফরিদা বেগমের ফ্ল্যাশ ফিকশনের ভুবন

আবু সাইদ কামাল
  ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ফরিদা বেগমের ফ্ল্যাশ ফিকশনের ভুবন
ফরিদা বেগমের ফ্ল্যাশ ফিকশনের ভুবন

আমরা জানি, বিশ্বসাহিত্যে ছোটগল্পের সুস্পষ্ট দুটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ধারা দুটি যথাক্রমে ছোটগল্প এবং ফ্ল্যাশ ফিকশন বা ঝলক গল্প। ২০০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০,০০০ শব্দসীমায় রচিত গল্পই ছোটগল্প। অপরদিকে ১৫০০ বা ২০০০ শব্দসীমায় সীমায়িত গল্পগুলো ফ্ল্যাশ ফিকশন। এ ঘরানার অন্তর্ভুক্ত হলেও ফ্ল্যাশ ফিকশনের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেদিকগুলো বিবেচনায় যাচাই করলে দেখা যায়, কথাসাহিত্যিক ফরিদা বেগমের গল্প লেখার ধারাটিই হলো ফ্ল্যাশ ফিকশনের।

আমরা জানি, গতিশীল ভুবনে দীর্ঘ পরিসরের কথাসাহিত্য লেখা এবং পড়ার মতো পর্যাপ্ত সময় আমাদের নেই। সেই দিক বিবেচনায় ফ্ল্যাশ ফিকশনের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়ে চলছে।

1

আধুনিক বাংলাসাহিত্যে ফ্ল্যাশ ফিকশন ধারায় রবীন্দ্র, নজরুল, সৈয়দ ওয়ালী উলস্নাহ, বনফুলসহ প্রতিষ্ঠিত অনেক গল্পকারই গল্প লিখেছেন। বর্তমানে বাংলা ভাষায় অনেকেই ফ্ল্যাশ ফিকশন লিখছেন। পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতায় ২০০০ শব্দের নিচে যেসব অতি ছোট গল্প প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোও ফ্ল্যাশ ফিকশনের অন্তর্ভুক্ত।

ফরিদা বেগমের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটি। প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম বিবর্ণ স্বপ্ন। গ্রন্থটির প্রকাশকাল ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৯৮। দ্বিতীয়টির নাম: গুলনারদের দিনকাল। এটির প্রকাশকাল: ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪। প্রথমটি প্রকাশের ২৬ বছর পর প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় গল্প গ্রন্থ। দুটি গল্পগ্রন্থে সূচিবদ্ধ কোনো গল্পের শব্দসীমা ১৫০০ শব্দের বেশি নয়। তার এসব লেখায় যে সারল্য, নিষ্পাপ আবেগ এবং গভীর অণুভূতি প্রকাশ পেয়েছে, তা পাঠকমনে অভাবনীয় প্রভাব ফেলে। ফ্ল্যাশ ফিকশন বা অতি ছোট গল্পে অল্পকথায় অণুভবের বিষয়টি তুলে আনা হয়। এ গল্পকারও অল্পকথার জাদুমন্ত্রে পাঠককে অভিভূত করেন।

ফ্ল্যাশ ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে প্রাণবন্ত ভাষা এবং সংবেদনশীল বিবরণ ব্যবহার ফ্ল্যাশ গল্পের তীব্রতা প্রদর্শন করে এবং এটিকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলে। ফরিদা বেগম তার এসব গল্পে এর সফল প্রয়োগ করেছেন। ফ্ল্যাশ ফিকশনের সৌন্দর্য তার সংক্ষিপ্ততায়। ফরিদা বেগমের প্রায় সব লেখাই সংক্ষিপ্ত।

তার প্রথম গল্প গ্রন্থটির গৌরচন্দ্রিকায় লেখক যা উলেস্নখ করেছেন, তার কিয়দ অংশের উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:

'প্রতিদিন যা দেখি, যা অণুভব করি তা কারও না কারও কাছে বলতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছে থেকেই গল্পগুলো লেখা।...। ডলি, মিরাজ, মুন্সী চাচা, এহসান, লটি, নিশু, কুসুম, জোলেখা, কালার বাপ এরা সবাই সুন্দরের স্বপ্ন দেখতে চায়। কিন্তু সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে ওদের স্বপ্নগুলো কেবলই বিবর্ণ হয়ে যায়। তবু এরা বাঁচতে চায়। তাই তো এই অসহায় মানুষগুলো আমাদের অণুভবের আঙিনায় জেগে থাকে...। আর সেজন্যই এদের আমি সবার সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। শান্ত হেনারাও তো চায় আপন বৈশিষ্ট্যে বেড়ে উঠতে। তাই আমরা ওদের উপেক্ষা করতে পারি না।'

প্রথম গল্প গ্রন্থটিতে মোট সতেরোটি গল্প সূচিবদ্ধ হয়েছে। গল্পগুলোর আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য বিচার করলে দেখা যায়, এগুলোর শব্দ পরিসর ১৫০০ শব্দের বেশি নয়। স্বল্প পরিসরের গল্পে বিষয় বৈচিত্র্য যেমন আছে, আছে নিজস্ব ভাষারীতি। সহজবোধ্য উপস্থাপনায় সমাজের নানা অসঙ্গতির ভাষিক চিত্র ফুটে উঠেছে।

প্রথম গল্পটির নাম শান্তর কষ্ট। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শান্ত স্কুলপড়ুয়া একটি শিশু ছেলে। সেদিক বিবেচনায় এটিকে আপাতদৃষ্টিতে শিশুতোষ মনে হতে পারে। তবে গল্পটিতে রয়েছে বড়দের মনে নাড়া দেওয়ার মতো গুরুত্ববহ বিষয়। শান্তর মা একজন প্রভাবশালী মহিলা। স্কুলের শিক্ষকগণ শিশু ছাত্রদের শাসন করবেন এটাই স্বাভাবিক। স্কুলে দুষ্টুমির জন্য শান্তকে শিক্ষক কিংবা তার সিনিয়র ছাত্ররা শাসন করে। তা জানতে পেরে শান্তর মা প্রতিক্রিয়া জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। প্রতিবাদী হয়ে স্কুল শিক্ষিকাদের সঙ্গে অসঙ্গত আচরণ করে।

মা যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, শান্ত তা বুঝতে পারে। মায়ের আচরণের কারণে স্কুলের শিক্ষকরাও শান্তর সঙ্গে শীতল আচরণ করে। তাই মায়ের প্রতি অভিমানি হয়ে শান্ত কারওকে না বলে একাকী পার্কে বসে থাকে। মা-বাবা বা স্বজনরা তাকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা। তখন তার বন্ধুরা পার্কে এসে তাকে খুঁজে পায়। বন্ধুদের সঙ্গে শান্ত মাকে অভিযুক্ত করে মনের কষ্টের কথা জানায়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিভাববকদের অসঙ্গত প্রভাব যে শিক্ষার্থীদের জন্য অশুভ ফল বয়ে আনে তার একটি সার্থক ভাষিক চিত্র এঁকেছেন গল্পকার।

গল্পটি ফ্ল্যাশ ফিকশনের শর্তগুলো পূরণ করেছে। যেমন: গল্পটির শুরুতে নাটকীয়তা আছে। গল্প শুরু করে বিদু্যৎ ঝলকের মতো চমক দিয়ে শেষ হয়েছে। এতে ঘটনা আছে, আছে চরিত্র এবং ডায়লগ। এতে একটি বিশেষ মূহূর্ত একটি দৃশ্যপটে উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পটি একটি ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয়েছে।

গ্রন্থে সূচিবদ্ধ দ্বিতীয় গল্পটির নাম কুসুম। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সবচে প্রিয় এবং সুন্দর ডাকটি হলো মা। জাগতিক কোনো সম্পর্কই মায়ের তুল্য হয় না। মা-হারা মেয়ে কুসুমের জানা ছিল না তার আসল মায়ের কথা। বিয়ের সময় যখন এই গোমর ফাঁস করা হয়, তখন কুসুমের যে অন্তর্ভেদী মানসিক হাহাকার দেখা দিয়েছে, সেই অণুভূতি দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন আর এক সন্তানহারা লেখিকা। মা-হারা বা সন্তান-হারা না হলে তেমন অণুভূতির গভীরে ডুব দেওয়া সাধারণ কোনো লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়।

গ্রন্থসূচির ক্রমধারায় তৃতীয় গল্পের নাম গুলি খাওয়া ছেলেটি। জাদুবাস্তবতা ধারায় লেখা অসাধারণ গল্প এটি। লেখিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবদমান শিক্ষার্থীদের দুটি পক্ষের মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। অকালে প্রাণ হারায় অনেকে। হলে শিক্ষার্থীদের নানা কাজ করত ছিন্নমূল বা অনাথ কিছু শিশু ছেলে। তেমনি একটি ছেলের নাম মিরাজ। সংঘাতে জড়ানো দুটি পক্ষের গোলাগুলির সময় গুলিবিব্ধ হয়ে মিরাজ মারা যায়। চারদিন ধরে পড়ে থাকে হাসাপাতালের মর্গে। মৃত সেই মিরাজই কথা বলে। গল্পের প্রধান চরিত্র সে। সে-ই ঘটনার শিকার হয়ে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে।

ছাব্বিশ বছর আগে লেখা গল্পটির আবেদন এখনো বেশ প্রাসঙ্গিক। বিশেষত কোটা সাংস্কার আন্দোলনে ১৬ জুলাই, ২০২৪ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘাতে এদেশে শতশত শিক্ষার্থী ও জনতা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নামলে কঠোর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে নিরীহ কেমালমতি ছেলেমেয়ে প্রাণ হারায়। শিক্ষার্থীরা একটি অরাজনৈতিক পস্নাটফর্ম থেকে আন্দোলনে নামলেও সেটিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে গেলে বিপত্তি দেখা দেয়। পাঁচ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনী নির্বিচার গুলিবর্ষণ করায় প্রায় ১০০০ মানুষ নিহত হয়। গল্পটি থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া যাক:

আহা রে!

সাবধান। আহারে কইবেন না। স্বার্থপরের দল। আপনেরা কিছু লুক আছেন যারা রাজনীতির নাম কইরা নিজেরা সুযুগ সুবিদা নেন, আর আমরার লাইগা রাখেন আহারে!

মৃত মিরাজ গুলিতে নিহত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পাভেলের সঙ্গে সংলাপে এসব বলে। বরাবরই এসব রাজনৈতিক সংঘাতের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। আর সুবিধা নেয় রাজনীতিবিদ সুবিধাভোগীরা।

গ্রন্থভুক্ত শেষ গল্পের নাম 'ওরা তো মুক্তিযোদ্ধা'। গল্পটির পাঠভ্রমণে পাঠকদের নিয়ে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। পাকহানাদাররা এদেশের নারী সমাজের ওপর কীভাবে যে যৌনসন্ত্রাস চালিয়েছে তার চিত্র উঠে এসেছে গল্পটিতে। যুদ্ধকালে সম্ভ্রম হারা নারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বলাই যে অধিক যুক্তিযুক্ত সে সম্পর্কে সামাজিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

গ্রন্থভুক্ত বাকি তেরটি গল্পে ভিন্ন ভিন্ন সমাজচিত্র উঠে এসেছে।

দুই

'গুলনারদের দিনকাল' নামে গভীর জীবনবোধের এই গল্পগ্রন্থটি পাঠকমনে স্থায়ী আসনলাভ করবে বলে আশা করা যায়। গ্রন্থভুক্ত অধিকাংশ গল্পই আকার ছোট। এগুলোর মধ্যে ২৮টিই অণুগল্প। বাকি ৭টি ছোট আকারে ফ্ল্যাশগল্প। যে কেউ পাঠ পড়ে বুঝবেন, গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি গল্প যেন যথাশব্দে সুষমামন্ডিত, চিত্রাত্মক ও সংকেতময়তায় ঋদ্ধ একজীবনের নান্দনিক সারাৎসার। চেতনায় আধুনিক ও প্রগতিশীল এই লেখক জীবনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত অনেক গল্পই গভীর বেদনার শিল্পরূপ।

সূচিবদ্ধ গল্পগুলো পাঠকমনকে পাঠানন্দে উলস্নসিত করে। গল্পগুলোতে রয়েছে বিষয়-বৈচিত্র্য। নানারকম উপাচারে সাজানো হয়েছে গ্রন্থভুক্ত গল্পের ডালি। যেন নানা ফুলে গাঁথা হয়েছে বহুবর্ণিল একটি ফুলের মালা। সহজবোধ্য ফ্ল্যাশ ফিকশন গ্রন্থটি পাঠকনন্দিত হওয়ার যোগ্য।

গ্রন্থসূচির প্রথম গল্পের নাম 'এক হৃদয়ের গল্প'। গল্পে শিউলি নামে মেয়েটি নিরাপদ সন্তান প্রসবের জন্য মায়ের কাছে আসে। সন্তানের জন্মও হয় মায়ের তত্ত্বাবধানে। ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। সন্তান জন্মদানের পর শিউলির রক্তপাত থামেনি। শিউলি আস্তে আস্তে না ফেরার দেশের পথ ধরে। মা শিশুটিকে শিউলির কাছে নিয়ে বলে, দেখ তোর ছেলে কী সুন্দর হয়েছে।'

জবাবে ক্ষীণস্বরে শিউলি বলে, মাগো আমি যে চলে যাচ্ছি।

মা আবার শিশুটাকে কাছে নিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। গল্প থেকে উদ্ধৃতি:

'মা এই ময়লা ন্যাকড়া দিয়ে নিয়েছ কেন? আমার হৃদয়ের জন্য একটা তোয়ালেও জুটল না'

বলে চোখ বন্ধ করল চিরতরে।

সেই ছেলে প্রকৃতির নিয়মে বাড়ত থাকে। তবে মা-হারা সন্তানের প্রতি যে পারিবারিক অবজ্ঞা তার মোকাবিলা করতে যে ছেলেটির অসহায়ত্ত গল্পটিতে তার হৃদয়মথিত হাহাকার পাঠকমনকে আর্দ্র করে তোলে।

গ্রন্থসূচির দ্বিতীয় গল্পের নাম 'পাড়ভাঙা ঢেউ'। নামকরণেই ভাঙনের সুর গল্পটি সম্পর্কে আগাম বার্তা দেয়। পারিবারিক ভাঙন হলে কোনো পরিবারের সদস্যদের যে দুর্বহ কষ্টে নিক্ষেপ করে, তার নিপুণ ভাষিক চিত্র এঁকেছেন লেখক।

গল্পের নায়িকা ফাহিমা সরকারি একটা কলেজে শিক্ষিকা। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কলেজের কোয়ার্টারে থাকত। ছিল সুখের সংসার। মেয়েটির বয়স বছর দশেক আর ছেলেটির সাত। সাপ্তাহান্তে স্বামী বাসায় আসতেন। একবার স্বামীর সঙ্গে তার ব্যবসায়ী এক বন্ধু বেড়াতে আসে। দুইদিন থাকে। যাওয়ার দিন-রাত থেকেই বন্ধুটির খুব জ্বর আসে। বন্ধুকে স্ত্রীর হাওলায় রেখে স্বামী চলে যায়।

জ্বর সারলেও পুরো সপ্তাহ সে থেকে যায়। দুজনের মধ্যে একটা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লোকটি স্বামীর অগোচরে চলে আসে ফাহিমার কাছে। ব্যাপারটি কাজের বুয়ার মাধ্যমে স্বামী জানতে পেরে একদিন সপ্তাহের মাঝখানে পরিবারের কাছে আসে এবং বাসায় বন্ধুকে দেখতে পায়।

স্ত্রীকে চাপ দিলে জবাবে বলে, 'আমি ওকে বিয়ে করব। তুমি আমার বাসা থেকে চলে যাও।'

ওদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বন্ধুটিকে বিয়ে করে ফাহিমা জীবন শুরু করে। কয়েকমাস ভালোই চলে। বন্ধুটি ছিল বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক। ফাহিমা এ কথা জানত। কয়েক মাস পর ওই বউ ফাহিমার বাসায় এসে ওঠে। নতুন স্বামী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। খুব তাড়াতাড়ি ফাহিমার শরীর ও মন ভাঙে। একসময় সে মানসিক ভারসাম্য হারায়। নতুন স্বামী তখন তার বউ, বাচ্চা আর ফাহিমার টাকা-পয়সা ও গহনাদি নিয়ে শটকে পড়ে।

এই কঠিন সময় ফাহিমার ভাইয়েরা পাশে দাঁড়ায়। চিকিৎসা করানো হয়। ভাইয়েরা বদলি করিয়ে ঢাকায় নিয়ে যায়। সেই থেকে ভাইদের সঙ্গে।

ফাহিমার ভাইয়েরা সাবেক স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। সাড়া পায় না। শেষে ফাহিমা তার সন্তান দুইটাকে একবার দেখতে চায়। তাতে সাবেক স্বামী ও বাচ্চারা কেউই রাজি হয় না।

গল্প কথক নাফিসার হাত ধরে ফাহিমা বলে, 'নাফিজা, তুমি আমার জীবনের কাহিনি নিয়ে একটি গল্প লেখ। গল্পটি ফেসবুকে দিও। সবাই পড়ে আমাকে ঘৃণা করে মন্তব্য করবে। আমি সেগুলো দেখব।

আগের স্বামীর সরলতা ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ সিদ্ধান্তই সংসার ভেঙেচুড়ে শেষ করে দেয়। গল্পে নিবোর্ধ স্বামী এবং সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতাহীন অসৎ স্ত্রীর কর্মের পরিণতি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। অণুশোচনায় দগ্ধ হয়ে বোধের সর্বোচ্চ জাগরণ না হলে গল্পের নায়িকা ফাহিমার মতো এমন মন্তব্য কেউ করতে পারে না।

সূচিবদ্ধ চতুর্থ গল্পের নাম 'নিষিদ্ধ পলস্নীর মেয়ে'। ভৈরব বাজারের নিষিদ্ধ পলস্নী বিলুপ্ত করার সময় একজন যুবতী পতিতা নিয়ে লেখা একটি অণুগল্প এটি।

সময়টা পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে। বুলবুলি নামে পতিতার ঠাঁই হয় নেহারদের বাসায়। একহারা গড়নের কমবয়সি একটি মিষ্টি মেয়ে। তাদের বাসার পেছনেই ছিল নিষিদ্ধ পলস্নী। নেহারের মা তাকে বুবু ডাকতে বলে। নেহার তখন স্কুলে পড়ে। সন্ধ্যার পর কয়েকজন মৌলভী সাহেব এসে ওকে তওবা পড়ায়। বুলবুলির চুলের আগাও একটুখানি কেটে দেওয়া হয়।

নেহার খুব খুশি হয়েছিল বুলবুলিকে পেয়ে। পলস্নীটি উচ্ছেদ করে মেয়েগুলোকে বের করে দেওয়া হয়। তাদেরই কাউকে কেউ স্ত্রীরূপে ঠাঁই দিয়, কেউ কন্যারূপে গ্রহণ করে।

নেহারের আব্বা বুলবুলিকে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে। বুলবুলি খুব ভালো মেয়ে। কয়েকটা দিন ভালোই কাটল। হঠাৎ একদিন সকালবেলা বুলবুলি বলে যে সে চলে যাবে। নেহারের বাবা-মায়ের অনেক বোঝানোর পরও চলেই গেল। যাবার সময় বলে গেল, যদি কোথাও জায়গা না পায় তাহলে ফিরে আসবে।

সে আর ফিরে আসেনি। দিন পনেরো পর বুলবুলির লেখা একটি পোস্টকার্ড আসে। তাতে লিখা ছিল তারা তাকে যে জীবন দিতে চায়, সে জীবন তার জন্য নয়। সে আবার কিশোরগঞ্জের নিষিদ্ধপলস্নীতে ঠাঁই নিয়েছে। সমাজের একটি পুরনো ক্ষত নিয়ে লেখা গল্পে যে বার্তাটি দেয়, তা হলো কেউ একটি লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হলে, সেখান থেকে সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না মানুষ।

ফ্ল্যাশ গল্পসূচির দ্বাদশতম গল্পের নাম 'মায়েদের রোগ'। মাত্র ৭১ শব্দের একটি সার্থক ফ্ল্যাশ বা অণুগল্প এটি। এখানে পুরোগল্পটি তুলে ধরা হলো:

শীতের সকাল। কুয়াশামাখা রোদের পরশ পেতে বারান্দায় বসেছি। বারান্দাটা দোতলার। বারান্দার পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে জিলা স্কুলের ড্রেস পরা এক কিশোর, সঙ্গে মা। ছেলেটি বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলছে 'আম্মা শুধু আমাকে নিয়ে পড়ে থাক। তোমার এই রোগটা কি সরবে না? মা নিশ্চুপ। ছেলে এবার আরও উত্তেজিত হয়ে বলছে, 'তুমি কি মনে কর আমি একা স্কুলে যেতে পারব না?'

মা এবারও নিশ্চুপ। তিনি রিকশা ডাকছেন। মায়েদের এই চিরন্তন রোগ কি সারে?

সত্যিই শাশ্বত এই রোগ থেকে কোনো মা-ই মুক্ত নয়। এ বিষয়টি আমাদের সবার জানা। বেশ দক্ষ শিল্পীর মতো নিপুণ হাতে অণুগল্পটিতে সন্তানের প্রতি মায়ের শাশ্বত ভালোবাসার ভাষিক চিত্র এঁকেছেন কথাশিল্পী ফরিদা বেগম।

ফ্ল্যাশ গল্পগ্রন্থের ক্রমিক বিশে থাকা গল্পের নাম 'ভালোবাসার গল্প'। কাব্যিক ভাষায় লেখা একটি চমৎকার প্রেমের গল্প এটি। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটির ভাষার মাধুর্যে, ঘটনা ও চরিত্রের সুবিন্যাসে উত্তীর্ণ একটি গল্প হয়ে উঠেছে।

গল্পের নায়ক তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কলেজ পর্যায়ে তার বোনের সহপাঠিনী এবং রুমমেট গল্পের নায়িকা।

বোনকে দেখতে ভিজিটরস ডেতে হোস্টেলে আসত। সহপাঠিনীর সঙ্গে নায়িকাও যেত। এভাবে দেখা হওয়া, কথা বলা। এক সময় আপনি সম্বোধন তুমি হয়। তারপর একটু-আধটু খুনসুটি হতে হতে একদিন তার কাছে ভালোবাসার একটা গল্প শুনতে চাইল। গল্পটা তখন তৈরি হচ্ছিল মাত্র। তাই বলা হয়নি।

বিএ পাস করে নায়িকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ওঠে রোকেয়া হলে। প্রথম দিনে তার মশারি ছিল না। রাতে প্রচুর মশার কামড় খায়। পরদিন বিকালে নায়ক দেখা করতে এসে এটা জেনে তখনই তার মশারিটা মেয়েটিকে দিয়ে য়ায়। এটাই ছিল ভালোবাসার গল্প।

নায়ককে শোনাল। গল্পের পরের অংশটুকু নায়কের নিজের গড়া। নিজের মতো করেই রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার অমিত রায়ের অণুসরণে গল্পের ইতি টেনেছিল।

মিলনে নয়, বিচ্ছেদেই প্রণয় মহিমান্বিত হয়। এ গল্পের পরিণতি পাঠকের বিরহের আনন্দে উদ্ভাসিত করে।

ফ্ল্যাশগল্প গ্রন্থের সূচিক্রম বত্রিশ অবস্থানে থাকা গল্পের নাম 'শকুনেরা সাবধান'। সংকেময়তা সমৃদ্ধ একটি সার্থক মুক্তিযুদ্ধকালের ঝলক গল্প এটি। গল্পের নায়ক নয়ন। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে, এই সংবাদ শুনে রাজাকাররা হানা দেয় তাদের বাড়িতে। বাবাকে বেঁধে নিয়ে যায়। বাধা দিলে মাকে হত্যা করে। মৃত মায়ের বুকে শুয়েছিল নয়ন। তাকে উদ্ধার করে বাবার এক বন্ধু। নয়নের বাবা আর ফিরে আসেনি। শেষে বাবার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর পরিবারেই বড় হয় নয়ন। তাকে পছন্দ করে রাখিয়া। রাখিয়ার বাবা ট্রাক ড্রাইভার, রাখিয়া সবসময় খান সাহেরের বাসার যাওয়া-আসা করে। ওখানেই নয়নের সঙ্গে রাখিয়ার ঘনিষ্ঠতা।

রাখিয়ার বিয়ের একটা প্রস্তাব এলে নয়নের সঙ্গে কথা বলে। বিয়ের কথা পাকা করতে রাখিয়াকে দিয়ে মা খবর পাঠায়। নয়ন যেতে চায় না। বলে বিয়ে করবে না।

এক্ষেত্রে গল্প থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া গেল:

তুমিও যাইবা আমার সঙ্গে।

কী করব গিয়া? আমি বিয়া করতে পারমু না।

অতদিনে এই কথা কও? এই কথাই যদি কইবা তাইলে ক্যান আমারে পুন্নিমার চাঁন দেখাইছিলা? ক্যান আমারে নারকেল গাছের পাতার শব্দে বাতাসের গান শুনাইছিলা?

রাখিয়ার আহ্বানে নয়ন সাড়া দেয় না। বরং সে বলে.

...তাই আমি ... যুদ্ধের ডাক শুনি।

...আমার চাইরদিগে কেবল শকুনদের পাখনার আওয়াজ পাই। তাই তো যুদ্ধের ডাক শুনি।

কার লগে যুদ্ধ করবি?

শকুনদের লগে!

গল্পের আর এক চরিত্র সিজারের সঙ্গে এসব বলে। শুধু ডায়ালগ নয়। যেন নাট্যমঞ্চ। সিজার চলে গেলে নয়নও দৃশ্যপট থেকে চলে যতে চায়। তখন রাখিয়া তাকে সঙ্গে যেতে বলে। গল্পের উদ্ধৃতি:

'পিলিজ বাসায় চল,' রাখিয়া নিশ্চিত বিশ্বাসে নয়নের দুহাতে উষ্ণ জীবনের বার্তা খুঁজে পেতে চায়। জবাবে নয়ন বলে,

না রাখি, আমারে ধরিস না। কইছি না আমি কেবল লাশের গন্ধ পাই। তোর থাইক্যাও পাই।

বিদ্রোহী নয়ন। সে যুদ্ধের ডাক শুনে। অস্ত্রের ভাষায় সমাজের অনাচার, অসঙ্গতি দূর করতে চায়। রাখিয়া তাকে ভালোবাসার আহ্বান জানায়। বলে,

'অহনও সময় আছ নয়ন। নয়ন তুমি আমারে ছোঁও তোমার ভাবনায় আমারে মিশশ্যা যাইতে দেও। তারপরে দুইজনে মিলল্যা শকুনদের থাবা থাইক্যা দেশটারে রক্ষা করমু। হেঁ নয়ন আমি তোমারে কথা দিতাছি, আমার কাছে রাজনীগন্ধা সুবাস আছে। আমরা পারমু।

রজনীগন্ধা সুবাস? আমি যে শকুন তাড়াইতে বারুদের গন্ধ চাই।

না নয়ন, তুমি ভুল করতাছ। তুমি কি জান না, বারুদের গন্ধে শকুনেরা উলস্নাস করে আর রজনীগন্ধা সুবাসে পায় ভয়।

শুধু প্রেম নয়, কখনো দ্রোহও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। সব সময় প্রেম ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায় না। সমাজ তথা দেশ কখনো দৈত্যের কবলে পড়ে যায়। তখন অনিবার্য দ্রোহের অগ্নুৎপাত না হলে দৈত্য-দানুর কবল থেকে সমাজকে উদ্ধার করা যায় না। দৈত্য-দানব কখনো প্রেম-ভালোবাসা বোঝে না। সজীব নারী এখানে মায়াবিনীর মতো পাষাণ দৈত্য হৃদয়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়ন এখানে দ্রোহের প্রতীক। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গণঅভু্যত্থানে দেড় যুগের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। দ্রোহ যাত্রায় হাজার হাজার মানুষ হতাহত হলেও সর্বনাশা এক নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকের কবল থেকে মুক্ত হয় এই দেশ।

ফরিদাবেগম রচিত এ গল্পটি কালকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণের আবেদন রাখার উপযোগী। পরিশেষে একথা বলা যায় যে, ফরিদা বেগম রচিত এই প্রকাশনাটি একটি সার্থক ফ্ল্যাশ ফিকশন গ্রন্থ। এর লেখক মূলত একজন দক্ষ এবং সার্থক ফ্ল্যাশ গল্পকার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে