শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

ব্যর্থপ্রেমের গল্প

সোনিয়া আক্তার
  ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ব্যর্থপ্রেমের গল্প

রাত এখন গভীর...

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, থেকে থেকে বজ্রপাতের আওয়াজে মনে হয় পুরো পৃথিবী কেঁপে উঠছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারিপাশ ছেঁয়ে আছে।

একটু পর পর বিদু্যতের আলোয় প্রকৃতিতে একটু ঝিলিক দিয়ে উঠছে।

মাঘের শীতের রাতে বৃষ্টিতে আবহাওয়া প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে গেছে। কনকনে শীতে সব মানুষ কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।

কিন্তু আমার দু'চোখে ঘুম নেই। আমি আজও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি বারান্দার গ্রিল ধরে। একরাশ হতাশা বুকে নিয়ে। তুমি আমার ছোট কাকার মেয়ে অনামিকা। আমার থেকে বছর পাঁচেক ছোট হবে। তুমি বাড়ির সবার ছোট বলে তোমাকে সবাই খুব আদর করত। আমিও অনেক আদর করতাম। তুমি আমার খুব ভক্ত ছিলে। তোমায় নিয়ে সাইকেলের পেছনে করে কত যে ঘুরেছি তার হিসাব নেই। আস্তে আস্তে তুমি বড় হতে লাগলে, তখন একটু দূরত্ব তৈরি হলো। কিন্তু তুমি ভাইয়া ভাইয়া বলে সারাক্ষণ কান ঝালাপালা করে দিতে। আমি খুব বিরক্ত হতাম। পড়ালেখা থেকে শুরু করে সব কাজেই আমার সাহায্য চাইতে। আমি ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিতাম। তুমি মন খারাপ করে কান্না করে ঘরে চলে যেতে।

তখনো পর্যন্ত তোমাকে আর আমার ছোটবোন টুম্পাকে কখনো আলাদা চোখে দেখিনি।

তোমাদের ঘরটা ছিল পশ্চিম দিকে আর আমাদের ঘরটা ছিল মুখোমুখি ঠিক পূর্ব পাশে। জানালার পাশে তুমি পড়তে বসলে আমাদের বারান্দা থেকে বরাবর দেখা যেত। একদিন রাতে প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া শুরু হলো, টিনের চালে বৃষ্টির এত ঢল পড়ছিল মনে হচ্ছিল ঘর ভেঙে যাবে, সঙ্গে বজ্রপাতের আওয়াজে ভয়ে বুক কেঁপে উঠছিল। হঠাৎই মনে হলো, বারান্দার দরজায় খিল দেওয়া হয়নি। আমি কোনোমতে দৌড় দিয়ে বারান্দার দরজাটা লাগাতে গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হঠাৎ করেই বিদু্যতের আলোয় চোখে পড়ল একটা চাঁদমুখ।

তুমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে হাত বের করে বৃষ্টি ধরছিলে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। এই প্রথম আমার তোমাকে দেখে নিজের ভেতর কেমন অন্যরকম অনুভূতি হলো। বৃষ্টির পানির এলোমেলো স্পর্শ তোমার মুখে পড়ছিল আর তুমি খিলখিলিয়ে হাসছিলে। তোমার সরল মুখের হাসি অমাবস্যার রাতেও পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছিল। জানালার বাইরে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ তোমার হাসির সঙ্গে ভেসে আসছিল।

এ যেন এক লোভনীয় দৃশ্য।

তুমি এতটাই যে সুন্দর তা আগে কখনো দেখিনি। বুকের ভেতর এই প্রথম কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো।

আমি আবারও বিদু্যৎ চমকানোর অপেক্ষায় থাকলাম। এবার আর বজ্রপাতের আওয়াজে আমি ভয় পাচ্ছি না, বাহির থেকে বৃষ্টি এসে আমায় পুরো ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু আমার কোনো হুঁশ নেই। আমি ঘোর অন্ধকারে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। শীতে আমার শরীর হিম হয়ে আসছিল। একটু পর তুমি জানালা বন্ধ করে দিলে। কিন্তু আমি সারারাত সেই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম যদি আর একবার আস তাই।

পরদিন সকালে আমি আর তোমার দিকে তাকাতে পারলাম না। নিজেকে বড্ড খারাপ মনে হতে লাগলো, অপরাধবোধে ভুগছি ভীষণ। এই তোমাকে আমি এমনভাবে কখনো ভাবিনি। কি হচ্ছে এসব, আমার সঙ্গে? কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি আমার মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। বারবার চারপাশে তোমার শূন্যতা অনুভব করছিলাম। কিন্তু তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কথা বলতে পারছিলাম না।

লজ্জায় আমার মাথা নত হচ্ছিল নিজের কাছেই।

কি সব হচ্ছে আমার সঙ্গে? এরপর থেকে যে রাতেই বৃষ্টি হতো আমি নিজের সঙ্গে হাজারো ঙ্গুদ্ধ করেও আর ঘরে থাকতে পারতাম না। চোরের মতো করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম তোমাকে একনজর দেখার জন্য। এমন বহুরাত পার হয়েছে তোমার অপেক্ষায়।

তুমি যদি কোনো দিন জানালার পাশে না আসতে আমি ভীষণ অস্থিরতা বোধ করতাম। চিৎকার করে তোমায় ডাকতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে বলব, আমি একথা? বাড়ির লোক আমায় খারাপ ভাববে।

তুমি আমাকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখবে- সেটা আমি মানতে পারব না। পাড়ার লোক মন্দ কথা বলবে।

আমি তোমার পাশে ছাঁয়ার মতো লেগে থাকলাম। তোমার সব কাজে এখন আমি সাহায্য করি, পাড়ার ছেলেদের দুষ্টুমির হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করি। তোমার যখন যা লাগবে বাজার থেকে এনে দেই। তুমি একপ্রকার নির্ভর হয়ে গেলে আমার ওপর। কিন্তু এতকিছুর পরও তোমার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারতাম না।

বলতে পারতাম না ভালোবাসি তোমায়!

ভয়, লজ্জা, জড়তা আমায় আঁকড়ে ধরতো। এভাবেই কেটে গেল পাঁচটি বছর।

তুমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করলে। বাড়ি থেকে তোমার বিয়ের গুঞ্জন শুরু হলো। আমার বুকের ভেতর কেমন অস্থিরতা শুরু হলো।

চাপা কষ্টে বুকটা ভার হয়ে থাকতো।

হঠাৎ একদিন রাতে বড় চাচা বাড়িতে দুই তিনজন লোক নিয়ে এলো। আমাকে টুম্পা ডেকে পাঠালো, আমি তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম তুমি সবার সামনে ওড়না দিয়ে ঘুমটা টেনে বসে রইলে। আমি ভেতর থেকে চুরমার হয়ে গেলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। সে রাতেই তোমার বিয়ে ঠিক হলো শহুরে বড় এক চাকরিজীবী ছেলের সঙ্গে।

পরের সপ্তাহে শুক্রবার তোমার বিয়ে। সারা বাড়ির লোকজন বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আমি কেমন যেন অথর্ব হয়ে গেলাম। শরীর ঠিকমতো কাজ করছিল না। নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেল আমার।

হাজার চেষ্টা করেও চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম।

মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা কেউ জোর বলে বের করার জন্য বেশ টানাটানি করছিল। কিন্তু আমি সেটা আটকানোর জন্য কোনো বল প্রয়োগ করতে পারছিলাম না।

তোমার হলুদ সন্ধ্যা সবাই অনেক আনন্দ করছিল। কিন্তু আমার বুকে প্রচন্ড ব্যথা করছিল। আমি বাড়ির পাশে পুকুর ধারে উদাস হয়ে বসেছিলাম। নিজেকে এতটা অসহায় আর কোনো দিন মনে হয়নি। হঠাৎ কেউ একজন পেছন থেকে এসে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল এই সজল চল... অনামিকার গায়ে হলুদ দিবি না? আমি বললাম হু....। তোমার গায়ে হলুদ ছোঁয়ালাম। কিন্তু তোমার দিকে আজও ঠিকমতো তাকাতে পারলাম না, আবছা একটু তোমায় দেখলাম। হলুদ শাড়িতে তোমার রূপ লাবণ্য ঝরে পড়ছিল কিন্তু তোমার চোখ ছলছল করছিল।

আমি তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। পরদিন তোমার বিয়ে। আমার সে রাতে প্রচন্ড জ্বর এলো। পরদিন সারাদিন আমি বিছানা থেকে উঠতে পারলাম না। আমি ঘরের এককোণে একা শুয়ে ছিলাম, সবাই বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। বাড়ি ভর্তি লোকের আনন্দ হৈ চৈ আমার বুকে বিষাদের তীর ছুড়ে দিচ্ছিল। শরীরে প্রচন্ড ব্যথা-যন্ত্রত্মণা সঙ্গে নিঃশ্বাসটা থেমে থেমে যাচ্ছিল। শ্বাস টানতে গেলও বুকে আটকে যাচ্ছিল আবার ছাড়তে গেলেও আটকে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এ যাত্রায় আর বেঁচে থাকব না। শরীর নিস্তেজ হয়ে দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। অনেক কষ্টে চোখেরপাতা খুলে দেখলাম তুমি লাল টুকটুকে শাড়ি পরে আমার হাত ধরে বসে কাঁদছো।

বললে ভাইয়া... আমি চলে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও আর আমার জন্য দোয়া করিও।

বহুদিন পর এই প্রথম আমি তোমার চোখের দিকে তাকালাম। তুমি এতটাই সুন্দর- যা কল্পনাকেও হার মানায়।

স্বর্গের সব রূপ যেন তোমার অঙ্গজুড়ে। আমি মৃদুস্বরে বললাম...ধুর!!!!পাগলি কাঁদিস কেন? আজ তর বড় সুখের দিন।

ভালো থাকিস...তুমি চলে গেলে হাতটি ছেড়ে। আর বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা বের করে সঙ্গে নিয়ে গেলে....

বহু বছর পার হয়ে গেল কিন্তু আজও আমি বৃষ্টির রাতে সেই আগের মতোই সারারাত ভিজে দাঁড়িয়ে থাকি তোমার অপেক্ষায়।

বৃষ্টির পানি বুদবুদ হয়ে ঢালে নেমে যায়, কামিনী ফুলের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়, বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রকৃতি ঠান্ডা হয়।

কিন্তু আমার বুকের জ্বলন বাড়ে দ্বিগুণ হারে। তীব্র হতাশায় চৌচির হয় হৃদয়।

তবে আজও কেউ জানলোনা... এ জ্বলার কি কারণ? বুঝলোনা এই বুকের জমানো কষ্ট!

শুধু জানে এই বৃষ্টির পানির বুদবুদ! আর এই কামিনী ফুল। আজও ভালোবাসি ঠিক সেই আগের মতোই।

ভালো থেকো 'প্রিয়া....'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে