মানুষের সহজাত প্রক্রিয়া 'চিন্তা'। স্বাভাবিক কোনো মানুষ চিন্তাহীন থাকতে পারে না। চিন্তাশক্তিই পৃথিবীর অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে পৃথক করেছে। এটি সতত পরিবর্তনশীল উপলব্ধিও বটে। চরাচরের যে কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় মানুষ চিন্তাক্লিষ্ট হয়। যা চিন্তার প্রাথমিক স্তর। এ স্তরে মানুষ তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে না। কেননা, ঘটনা পরম্পরায় মানুষের চিন্তার স্তরগুলো দ্রম্নত পরিবর্তিত হতে থাকে। চিন্তার প্রতিমুহূর্তের এই পরিবর্তন মানুষের মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ তৈরি করে এবং ঘাত-অভিঘাত-দ্বন্দ্ব, ভাঙচুর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষ একসময় চিন্তার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হতে সক্ষম হয়। এ পর্যায়ে এসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মানুষ। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও ভিত্তি রয়েছে। এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য চিন্তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো নয়। এ নিবন্ধে কবির চিন্তাবিশ্ব, চিন্তার স্বাধীনতা ও কবিতায় চিন্তার প্রতিফলনের বিষয়টি অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে।
২.
কবির চিন্তাবিশ্বের সন্ধান কিংবা কবিতার শিল্পবিচার অথবা আলোচনার ক্ষেত্রে 'ব্যক্তির রুচি আর শিল্পের নৈর্ব্যক্তিকতা পরস্পরের কাছে দুরাত্মা নয়, দূরাত্মীয়'- এটা মনে রেখেই কবিতার একজন সাধারণ পাঠক আমি। কবিতায় চিন্তাবৃত্তি আলোচনায় আমার অবস্থান কিছুতেই কাব্য-বোদ্ধার গুরুত্ব বহন করে না। আমার ধারণা, 'কবি' সর্বপ্রথম একজন সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ সমাজেই তার বসবাস। চিন্তার গভীরতা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের কারণে তিনি হয়ে ওঠেন সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের কোনো ঘটনা কিংবা প্রকৃতি-পরিবেশ, সমাজ-রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতি-সমৃদ্ধিসহ যে কোনো বিষয় একজন কবির হৃদয়ে যে সংবেদনা তৈরি করে, তা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে না-ও করতে পারে। আবার সাধারণ মানুষের মনে সংবেদনার এই প্রবণতা স্পষ্ট হলেও তার যথাযথ প্রকাশ ও প্রয়োগে তারা সক্ষম হন না। কবি যেহেতু সৃজনশীলতার চর্চায় আত্মনিবেদিত, কবির লেখনিতে তাই মনোজাগতিক ভাঙচুর, নেতিবাচক-ইতিবাচক প্রবণতা সহজেই দৃশ্যমান হয়। ব্যক্তিজীবনের উত্থান-পতন যেমন একজন কবিকে জীবনের মর্ম অনুসন্ধান ও তার বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি সামষ্টিক বিষয়াদির ধারণ ও প্রকাশেও কবির সক্ষমতা প্রতিভাত হয়। কবিতায় নানান প্রপঞ্চের সন্নিবেশের ক্ষেত্রে কবির একধরনের দায়ও আছে।
কবিতায় চিন্তার পরিচর্যা ও তার প্রতিফলন বুঝতে কবির চিন্তার ক্ষেত্রসন্ধানও জরুরি। এক্ষেত্রে প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা উলেস্নখ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পলস্নী-পুনর্গঠন, কৃষি ও কুটির শিল্পের বিকাশ, কৃষির উন্নয়ন ও সংশ্লিষ্টদের ভাগ্যোন্নয়নে পুত্র ও জামাতাকে কৃষিবিদ্যা শিখতে বিদেশ পাঠানো, তাঁতীদের জন্য বয়ন-বিদ্যালয় এবং চাষীদের সহজে ঋণ প্রাপ্তির জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ যখন জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মমতার প্রতিবাদে 'নাইট উপাধি' ত্যাগ করে নির্যাতিত মানুষের কাতারে দাঁড়ান; তার রচনাকর্মেও এসব বিচিত্র বিষয়াদি যেমন, মানুষের জীবনধারা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সভ্যতা-উন্নয়ন চিত্রায়িত হয়; তখন এ কথাটিই সামনে আসে যে, সৃজনশীল ব্যক্তির কর্মের মধ্যেও তার চিন্তার সারবত্তা উপস্থিতি থাকে। প্রশ্ন হতে পারে, সাহিত্য রচনার বাইরে এসব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ কেন? উত্তর পাওয়াও অসম্ভব নয়। একজন কবি একই সঙ্গে 'স্রষ্টা' এবং 'দ্রষ্টা'- বলেছেন বোদ্ধারা। কবি যেহেতু ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, তাই তার চিন্তাভুবনের প্রসঙ্গটি চলে আসে। একজন কবির চিন্তাবিশ্বের সন্ধান পাওয়া খুব সহজ, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, সৃজনশীল মননে ভবিষ্যতের ভাবনা পাখা মেললেও তিনি তা সহজে প্রকাশ করেন না। তার চিন্তা যখন প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবস্থানে এসে পৌঁছে, তখনই তিনি তা প্রকাশ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই প্রকাশ হতে পারে চিন্তালব্ধ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ভেতর দিয়ে। ততদিন সাধারণ মানুষের অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
পাবলো নেরুদা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- 'এমন কবিও আছেন যারা জীবনকে জানেন, তার সমস্যাগুলো বোঝেন ও স্রোতের মধ্যে দিয়ে চলে টিকে থাকেন। তারা দুঃখবোধের মধ্য দিয়ে পূর্ণতার দিকে ধাবিত হন।' পাবলো নেরুদার খ্যাতি রয়েছে 'প্রেম ও রাজনীতির কবি' হিসেবে। তার বক্তব্য এবং রচনাসম্ভারে উদ্ভাসিত দুঃখ ও ক্ষুদ্রতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকে আনন্দ ও পূর্ণতাকে স্পর্শ করার অঙ্গীকার। বিশ্বের সকল কবিতার ধারাবাহিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বাঁকবদল ও প্রতিবাঁকের বিষয়টিও স্পষ্ট। তার চেয়েও বড় সত্য, 'ভাষায়, প্রকরণে, প্রকাশশৈলীতে শক্তিমান কবিমাত্রই স্বতন্ত্রস্বরের অধিকারী। স্বাধীনচিত্ত, কণ্ঠস্বাতন্ত্র্যই কবি থেকে কবিকে পৃথক কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। তিনি কবি হয়ে ওঠেন শিল্পের প্রতিভূ; আপন শক্তির স্মারক।' একজন কবির 'আপন শক্তি স্মারক' হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার চিন্তাবিশ্বের ভাঙচুর ও স্বাধীনতাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
৩.
গল্পকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ 'বনলতা ও হেলেন' প্রবন্ধে উলেস্নখ করেছেন, 'একজন ঔপন্যাসিক একটিমাত্র উপন্যাস লিখেই কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করতে পারেন, আর না লিখলেও চলে। কিন্তু একজন কবিকে কীর্তিস্তম্ভ স্থাপন করতে হলে একটি কবিতাই যথেষ্ঠ নয়। তার কারণ নিছক আকারের হ্রস্বতা নয়; একজন কবির সব কবিতা মিলেই একটি প্রবাহ, একটি ব্যক্তিত্বের চৈতন্যস্রোত বলাই ভালো এবং তার একটিমাত্র কবিতায় সেই প্রবাহ ধরা পড়ে না। উপমা দিয়ে বলা চলে, একটি কবিতা বিশাল আকাশের একটিমাত্র নক্ষত্রের মতো। কবি যেন সেই আকাশ এবং তাকে ধারণ করতে হয় অন্ধকারে 'অনন্ত নক্ষত্রবীথি'। এই নক্ষত্রমালার সমগ্রতার মধ্যেই নিহিত থাকে একজন কবির প্রকৃত পরিচয় এবং সে-পরিচয়ের সূত্রেই তার কোন কবিতার সঠিক, খাঁটি, অবিকৃত আত্মার মুখোমুখি হওয়া সম্ভব হয়।"
একজন কবিকে সমাজস্বীকৃত সততার পাশাপাশি শিল্পসততা উপস্থাপনেও সজাগ থাকতে হয়। প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হকের ভাষায়, কবিকে 'শনাক্ত করতে হয়, সমাজের অসুখ, অবক্ষয় ও সম্ভাবনার সূত্রগুলো। তার আবিষ্কৃত সূত্রগুলোর আলোকেই তাকে বাস্তবতার চিত্র আঁকতে হয়, লিখতে হয় স্বপ্নের কথাও। তাকেই ঠিক করতে হয়, প্রচলিত সমাজবাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে, তিনি কী ধরনের সমাজ সৃষ্টি করতে চান, তা-ও। কেবল সমাজে সংঘটিত ঘটনাবলির চিত্র শিল্পী আঁকেন না, সমাজকে কিভাবে কল্পনা করেন, তা-ও তাকে দেখিয়ে দিতে হয়। এখানেই সাংবাদিক প্রতিবেদনের সঙ্গে কবির তফাত। সাংবাদিক যেখানে সংঘটিত ঘটনাবলির বর্ণনা দেন, কবি সেখানে ওই ঘটনার সঙ্গে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার রঙও চড়িয়ে দেন। কাজটি করতে গিয়ে কবিকে চিন্তা করতে হয়, সামাজিক বাস্তবতার রূপ, রাজনৈতিক চেতনা, ঐতিহাসিক পটভূমি, ঐতিহ্যের রূপায়ণ, স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, প্রকৃতি ও অধ্যাত্মচেতনাসহ বহুমাত্রিক বিষয়।' ধারণা করি, এভাবে একজন কবি চৈতন্যকে চিন্তায় এবং চিন্তাকে দার্শনিক চিন্তা-প্রজ্ঞায় উত্তীর্ণ করে তুলতে সক্ষম হলে প্রকৃত কবির মর্যাদায় উঠে আসতে পারেন।
৪.
নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়েই আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র। প্রতিদিন মানুষ পার্থিব, অ-পার্থিব বিষয়ে ভাবনাবিনিময় করে। তবে, এই বিনিময়ের বেশির ভাগই সামাজিকতা। এর ভেতর ভদ্রতা আছে সত্য, কিন্তু আন্তরিকতার অভাব। প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে; অথচ নেপথ্য কারণ নিয়ে গভীর বিবেচনা নেই; একই সঙ্গে অনুপস্থিত দার্শনিক জিজ্ঞাসা। অধ্যাপক ও চিন্তাবিদ ড. হায়াৎ মামুদের মতে, 'মানুষ নামের প্রাণীটি জীবজগতে যে-কারণে বিশিষ্ট সেই চরিত্রধর্ম মৌলিকভাবে ভিন্ন। তার মননশক্তি ও চিন্তাশক্তি রয়েছে, যা অন্য প্রাণীতে অনুপস্থিত। তার এই চিন্তাশক্তিই তাকে বৈচিত্র্যসন্ধানী ও প্রশ্নমুখী করে তোলে। ফলে, সংখ্যায় তারা যত কমই হোক, কিছু কিছু মানুষ থাকেই যারা স্থিতাবস্থায় আরাম পায় না, তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, তারা তর্কবিতর্কে ভেতর দিয়ে তাদের প্রশ্নের মীমাংসা খোঁজে' (প্রবন্ধ : চিন্তার রকমফের)। সুতরাং একজন প্রকৃত কবিকে দার্শনিক জিজ্ঞাসার অধিকারী হিসেবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। একজন কবির নিজস্ব বিবেকের সংহিতাই তার চিন্তাবৃত্তি। সে সংহিতা তৈরি হয়ে ওঠে ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞান, শুভ-অশুভের বিচারক্ষমতা ও সর্বোপরি হৃদয়ের গভীরে মায়া-মমতার উৎসারণ মিশিয়েই। কবিমননে জিজ্ঞাসার জন্ম না হলে, চিন্তার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে পারে না। তখন পার্থিব কিংবা অপার্থিব কোনো বিষয়েই সৃষ্ট কৌতূহল নিবৃত্ত হওয়াও সম্ভব নয়। কবিমননে উদ্ভূত নানান জিজ্ঞাসা ও সমস্যা সমাধানের নিরিখে যে-চিন্তার ক্রমবিকাশ, তাকে আশ্রয় করেই কবির কল্পনামনীষা, আর এটাই কবির দর্শন। 'কবিতায় চিন্তা' প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের 'বোধ' কবিতাটি উলেস্নখযোগ্য সংযোজন হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। জীবনানন্দের কবিতায় চিন্তার আলোকসম্ভারে আলোকপাত করতে ড. দীপ্তি ত্রিপাঠীর বিবেচনা আলোচনায় নেওয়া যেতে পারে। দীপ্তি ত্রিপাঠী উলেস্নখ করেছেন, 'এক বিমূঢ় যুগের বিভ্রান্ত কবি জীবনানন্দ। পৌষের চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রির প্রকৃতির মতো তার কাব্য কুহেলীকুহকে আচ্ছন্ন। আধুনিক কবিদের মধ্যে একমাত্র তার কাব্যেই এ যুগের সংশয়ী মানবাত্মার ক্ষতবিক্ষত পরিচয়টি ফুটে উঠেছে। জীবনানন্দের অন্তর্লোকে যে সমুদ্র মন্থন চলছে তার উগরানো বিষ তাকেই পান করে নীলকণ্ঠ হতে হয়েছে। এজন্য তার কাব্যে ট্র্যাজিক মহিমা এত বেশি মর্মভেদী। অন্যান্য কবিদের কাব্য রসাস্বাদনের জন্য পূর্বেই যে পঠন-পাঠনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, জীবনানন্দের কাব্য পাঠে তার বিশেষ মূল্য নেই। পূর্বে নয়, পাঠান্তেই তার কাব্য পাঠক মানসে আলোড়ন তোলে এবং শেষপর্যন্ত মনে হয় অর্থের দুর্বোধ্যতা, ছন্দের অভিনবত্ব, শব্দের বৈচিত্র অপেক্ষা চিন্তার রহস্যভেদ অনেক বেশি দুরূহ।' ফলে কবিতায় চিন্তার প্রভাবের বিষয়টি আধুনিক কাব্যপাঠক, আলোচক এবং সৃজনশীল ব্যক্তিরা অস্বীকার করতে পারেন না বলেই ধারণা জন্মে।
৫.
'আমি বিশ্বাস করি কবিতা হচ্ছে একটা একদিনের কাজ, যার মধ্যে সমান অংশীদার হিসেবে নিহিত থাকে নৈঃসঙ্গ্য ও সংহতি, আবেগ ও সক্রিয়তা, এবং নিজের, মানবসম্প্রদায়ের ও প্রকৃতির গোপন প্রকাশের প্রতি ঘনিষ্ঠতাবোধ। সব পথের একই গন্তব্য, সেটা হলো আমরা কী- সে বার্তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া। উলস্নাসের জায়গায় পৌঁছানোর জন্য আমাদের অবশ্যই নৈঃসঙ্গ ও কষ্ট এবং বিচ্ছিন্নতা ও নিরবতার মধ্যে দিয়ে এগোতে হবে, সেখানে আমরা আমাদের কদর্য নাচ নাচব, দুঃখের গান গাইব, কিন্তু এইসব নাচ-গানের মধ্যে একটা শর্ত পূরণ হওয়া চাই- সেটা হলো, আমরা যে মানুষ এবং আমাদের গন্তব্যও যে অভিন্ন, সবচেয়ে প্রাচীন; সেই সচেতনতা, বিশ্বাস ও নীতিজ্ঞান থাকতে হবে' (পাবলো নেরুদা কিংবদন্তি কবি, প্রবন্ধ : নাজিব ওয়াদুদ)। নেরুদার এ বক্তব্যটিকে ধারণ করে বলা যেতে পারে, যে কবি বাস্তববাদী নন, তিনি মৃত। আর যে কবি শুধুই বাস্তববাদী, তিনিও ততোধিক মৃত। যে কবি অযৌক্তিকতায় আচ্ছন্ন, তার কবিতা বুঝবেন কেবল তিনি আর তাকে যারা ভালোবাসে। এটা খুবই দুঃখের। আবার যে কবি তত্ত্ববাগীশ, তাকেও বুঝবে কেবল তার অনুসারীরা। এটাও দুঃখের। কবিতার জন্য কোথাও কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম থাকা সঙ্গত হতে পারে না। এর অর্থ এই নয় যে, একজন প্রকৃত সৃজনশীল 'যা খুশি' তাই লিখবেন। 'উৎকৃষ্ট' কবিতার পর্যালোচনায় যেসব অনুষঙ্গ নিরূপণ করেছেন কাব্যবিশেষজ্ঞরা, কবিতায় সেসব প্রপঞ্চের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। ছন্দবদ্ধতা, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা অথবা অন্যান্য রূপকল্পের বাইরেও কবিতায় থাকবে একটি মননশীলতার জগৎ- যেখানে মিলবে চিন্তাশীল দিকনির্দেশনা। বোদলেয়ার কথিত কবির সেই দ্রষ্টা চোখ- যেখানে কবি শুধু কাব্যনিষ্ঠই নন, সত্যনিষ্ঠও। 'কবিতায় চিন্তাবৃত্তি' বলতে নিরেট কোনো জ্ঞানময় উক্তিকে নয়, বরং বুঝায় এমন এক চৈতন্যকে যা পাঠককে দার্শনিক সত্যে উপনীত করে। দর্শন কোনো অর্থেই কবিতা নয়। কিন্তু কবিতায় দর্শনের সারবত্তা একটি প্রয়োজনীয় প্রণোদনা। কবিতার গভীরতা ও বিষয়ভিত্তিক মূল্য নির্মাণের জন্যই তা জরুরি।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, অগ্রজদের 'চিন্তাবৃত্তি'কে সম্পূর্ণ আত্মস্থ না করে কিংবা কবিতা রচনায় চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে কবিতার নামে, বুদ্ধিবৃত্তির নামে, জ্ঞানচর্চার নামে নিজ নিজ অসুস্থতা, বিকার ও মূর্খতাকে প্রকাশ করলে তা কবিতা পদবাচ্যে গৃহিত হতে পারে না। পৃথিবীর সমকালীন মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার উৎসারণ আছে এমন কবিতা শেষাবধি টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। কবির চিন্তাবিশ্বে সৃষ্ট যথাযথ চিন্তার উপযোগিতাকে খাটো করে দেখার সুযোগও থাকে না।