মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

কাজের মূল্যায়ন

নিন্দিনী ডেস্ক
  ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কাজের মূল্যায়ন
কাজের মূল্যায়ন

নারীরা আজ ঘরে-বাইরে সমান কর্ম দক্ষতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে। এক সময়ের অসূর্যস্পর্শা, অন্তঃপুরবাসিনী ললনারা আধুনিক যুগে সময়ের যৌক্তিক চাহিদায় পরিবারের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে সদর্পে বিচরণ করে যাচ্ছে। সে যুগে নারীরা গৃহস্থালি সেবা দিয়ে স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব পালন করে যেত। সেখানে আজ পরিবর্তনের ছোঁয়া দেখা দিয়েছে। তাই সীমাবদ্ধ সাংসারিক বলয় থেকে আরও সম্প্রসারিত জগতে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান

হচ্ছে। কর্মক্ষেত্র তো বটেই তার চেয়েও বেশি পারিবারিক ঘরোয়া পরিবেশকেও সামলানোর চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ কর্মজীবী মেয়েরা পুরুষের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অংশ নিলেও সংসার থেকে ছুটি মোটেও মিলছে না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে তার পুরুষ সহকর্মীরা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে থাকা স্বামীটি ঘরে-বাইরে একই সঙ্গে তার যথার্থ কর্মটি করে যাচ্ছে কিনা। বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে এমনটি দেখা যায় না। প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান একজন পেশাজীবী নারী তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব সম্পন্ন করে কাজের ক্ষেত্রে ছুটে যাচ্ছে। রান্না-বান্না, সন্তানের লালন-পালন, স্কুলে পাঠানো, স্বামীর সর্বাধিক দায়দায়িত্ব শেষ করে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার। এখানেও তার গৃহস্থালি শ্রমের অবমূল্যায়ন করা হয়। আর যারা শুধু সংসারেরই কর্ত্রী তারা উদয়াস্ত শ্রমের বিনিময়ে পারিবারিক গতিপ্রবাহকে সচল রাখতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখে। ভূমিনির্ভর কৃষি অর্থনীতিতে গ্রাম-বাংলার শ্রমজীবী নারীরা যে মাত্রায় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে যায়, সেখানে তার যথার্থ কর্মের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। স্মরণকাল থেকে গৃহস্থালি কাজে মেয়েদের সরাসরি সম্পৃক্ততা কৃষি সভ্যতার বীজবপন থেকে আরম্ভ করে আধুনিক কালের যন্ত্রনির্ভর সমাজ ব্যবস্থায়ও অসাধারণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। অবরোধবাসিনী নারীরা এক সময় ঘরেই তাদের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রাখত।

1

সেখানেও গৃহকর্ম ছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়ায়ও তাদের অংশীদারিত্ব ছিল নজরকাড়া। গৃহিণী নারীরা উঠানের এক পাশে শাকসবজি ও ফলমূলের বাগান করত, শুধু তাই নয়, হাঁস-মুরগি পালন থেকে গরু-ছাগলের দেখভাল করাও ছিল তাদের নিয়মিত দায়িত্ব। ঘরের প্রয়োজন মিটিয়েও একজন সুদক্ষ গৃহিণী বাজার ব্যবস্থায় নিজেকে সম্পৃক্ত করত। অতি অল্প হলেও সেখান থেকেও সামান্য আর্থিক সচ্ছলতা এসে যেত।

তখনও নারীর এমন সব কর্মক্ষেত্রকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি- যা আজও অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গ্রাম-বাংলায় যেসব নারী কোন এককালে ঘরে বসেই উৎপাদন প্রক্রিয়া নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে আজ তারা ফসলি জমিতেও তাদের মূল্যবান সময় এবং শ্রমকে অবারিত করেছে। একজন নারী কৃষক যখন ক্ষেতে যায় উৎপাদন অংশ নিতে সেখানেও তাকে গৃহস্থালির সর্ববিধ দায়িত্ব সম্পন্ন করেই ফসলি জমিতে যেতে হয়। তার সহকর্মী স্বামীও ক্ষেতে যায়- কিন্তু স্ত্রীর মতো সংসার সামলায় না। এখানে শ্রমজীবী নারী সূর্য উদয়ের আগে কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে পারিবারিক কাজকর্ম গোছাতে হয়। ছোট্ট শিশু যদি থাকে তার যথার্থ পরিচর্যা করতে হয়। স্কুলগামী সন্তান যদি থাকে তাকেও বিদ্যালয়ে পাঠানোর উপযোগী করে তৈরি করতে হয়। সেখানেও সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, টিফিন নেয়া, ড্রেস ঠিক করা সবই মায়ের দায়িত্ব বলেই বিবেচনা করা হয়। তার ওপর কর্মজীবী স্ত্রীকে নিজের দিকেও কিছুটা খেয়াল রাখতে হয়- স্বামীর দেখভাল করাও স্ত্রীরই দায়িত্ব। সংসার, ঘর সামলিয়ে যখন সে মাঠে ছোটে সেখানে তার কর্মঘণ্টা এবং শ্রম ও সময় পুরুষ সহকর্মীর মতো। কিন্তু নারী হিসেবে মজুরি পায় সে অপেক্ষাকৃত কম।

পুরুষের যদি ৫০০ টাকা হয় দিনপ্রতি সেখানে একজন নারী ৩০০-৩৫০ পর্যন্ত পায়। এখানে তার কঠিন শ্রমকে হরেক রকম বেড়াজালে অবমূল্যায়ন করা হয়। আধুনিকতার নব্যযুগে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির সফল অগ্রগামিতায়। যন্ত্র এবং সময়কে মানুষ গ্রহণ করলেও সেখানে সার্বিক চেতনা অনেক পেছনে পড়ে থাকে।

সময়ের সঙ্গে চৈতন্যের বিকাশ যদি অধোগতি হয় তাহলে কোনভাবেই প্রচলিত সামাজিক অভিশাপ আর অপসংস্কারকে ঠেকানো সম্ভব হবে না। পরিবারের পুরুষ কর্তা ব্যক্তিটি যদি মনে না করেন তার কর্মজীবী স্ত্রীকে সাংসারিক কাজে সহযোগিতা দেয়া উচিত তা হলে তার সন্তান পরবর্তী প্রজন্ম তেমন শিক্ষা নিয়েই বড় হবে।

তিনি যেমন তার বাবার কাছ থেকে এমন চেতনাই ধারণ করেছেন যেখানে তার মা ও সর্ববিধ দায়িত্ব পালনে সর্বংসহা ছিলেন। সুতরাং, গতানুগতিক চেতনার এই রুদ্ধদ্বারে সজোরে কড়া নাড়তে হবে- যাতে সবার মাঝে সম্বিত ফিরে আসে নারীরাও মানুষ। মানুষের মর্যাদায় তাদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হলে এমন কট্টর সামাজিক অবয়বকে উত্তরণ করা যাবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে