মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

বস্ন্যাকহোলের আদ্যপান্ত

প্রচন্ড আকর্ষণের কারণে সবকিছু ছুটছে বস্ন্যাকহোলের দিকে। কেউ যদি বস্ন্যাকহোলের ভেতর কোনোভাবে চলে যায়, তাহলে আর কখনোই ফেরত আসতে পারে না। অর্থাৎ ঠিক এই কারণেই বস্ন্যাকহোলের ভেতরে কি হচ্ছে, তা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বস্ন্‌্যাকহোলটির দূরত্ব মাত্র ১৫ হাজার ৬৬ আলোকবর্ষের মতো। এটি এমন একটি হোল বা গর্ত, যা নিজের দিকে টেনে নিতে পারে সবকিছু। মহাবিশ্বে এ রকম অনেক বস্ন্যাকহোল রয়েছে। মানে বহু নক্ষত্র মরে গিয়ে বস্ন্যাকহোলে পরিণত হয়েছে। মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যে মোড়া বস্তুটি হলো বস্ন্যাকহোল
অলোক আচার্য
  ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বস্ন্যাকহোলের আদ্যপান্ত
বস্ন্যাকহোলের আদ্যপান্ত

এই মহাবিশ্ব অনন্ত, অসীম। মহাবিশ্ব ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। কোথায় এর শেষ হবে, তা অনিশ্চিত। বৈজ্ঞানিক গবেষণা সেটি প্রমাণ করতে পারেনি। এই মহাবিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে কোটি কোটি নক্ষত্র। রয়েছে গ্যালাক্সি। এসব নক্ষত্র প্রকৃতির নিয়মে জন্ম হয় আবার মৃতু্য হয়। নতুন নতুন নক্ষত্রের জন্ম এখনো হচ্ছে। শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে সেসব রহস্যের ক্ষুদ্রাংশ ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর আগের নক্ষত্রের জন্ম ধরা পড়ছে টেলিস্কোপে। আবার মৃতু্য রহস্যও সামনে আসছে। আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে রাতের আকাশের তারা মিটিমিটি জ্বলতে দেখতে পাই। এগুলো আসলে এক একটি নক্ষত্র। এই যেমন সূর্য একটি নক্ষত্র। পৃথিবীর প্রাণ বাঁচিয়ে রেখেছে সূর্য। এ রকম অসংখ্য নক্ষত্র এই মহাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, নক্ষত্র কতকাল এভাবে আলো দিতে পারে? এর উত্তর হলো- যতদিন এর ভেতরে জ্বালানি থাকে। এরপর একদিন নক্ষত্রের মৃতু্য ঘটে। নক্ষত্র মরে গেলে কী ঘটে? নক্ষত্র মরে গেলে বস্ন্যাকহোলে পরিণত হয়। যাকে আমরা বাংলায় বলি কৃষ্ণগহ্বর। মহাবিশ্বে বস্ন্যাকহোল একটি রহস্যময় বস্তু। এর কারণ সম্ভবত এর ভেতরটা অন্ধকার। প্রচন্ড আকর্ষণের কারণে সবকিছু ছুটছে বস্ন্যাকহোলের দিকে। কেউ যদি বস্ন্যাকহোলের ভেতর কোনোভাবে চলে যায়, তাহলে আর কখনোই ফেরত আসতে পারে না। অর্থাৎ ঠিক এই কারণেই বস্ন্যাকহোলের ভেতরে কি হচ্ছে, তা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বস্ন্‌্যাকহোলটির দূরত্ব মাত্র ১৫ হাজার ৬৬ আলোকবর্ষের মতো। এটি এমন একটি হোল বা গর্ত, যা নিজের দিকে টেনে নিতে পারে সবকিছু। মহাবিশ্বে এ রকম অনেক বস্ন্যাকহোল রয়েছে। মানে বহু নক্ষত্র মরে গিয়ে বস্ন্যাকহোলে পরিণত হয়েছে। মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যে মোরা বস্তুটি হলো বস্ন্যাকহোল। বস্ন্যাকহোল হলো- মহাবিশ্বের কিছু মৃত তারা বা নক্ষত্র, যা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে, এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোনো বস্তুকে একেবারে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এটি মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু, যার ভর অনেক বেশি; কিন্তু আয়তন তুলনামূলক কম। যা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে, এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোনো বস্তুকে একেবারে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এটি মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু, যার ভর অনেক বেশি; কিন্তু আয়তন তুলনামূলক কম।

একটি নক্ষত্রের নির্দিষ্ট জ্বালানি নিঃশেষ হয়ে গেলে এর মৃতু্য ঘটে। যতক্ষণ পর্যন্ত এর অভ্যন্তরীণ হাইড্রোজেন গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর ভেতর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া চলতে থাকে। হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে এর কেন্দ্রীয় মূলবস্তু সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে একটি তারার মৃতু্য হয়। ১৭৮৩ সালে ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল রয়েল সোসাইটির সদস্য বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে লেখা এক চিঠিতে এর সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন। জন মিচেল নামের এক ব্রিটিশ জ্যোর্তিবিদ ১৭৮৪ সালে প্রথম বস্ন্যাক হোলের সম্ভাবনার কথা বলেন। মিচেল তাদের নাম দেন অন্ধকার নক্ষত্র। উনি দেখান যে, যদি এমন নক্ষত্র থাকে, যার ঘনত্ব প্রায় সূর্যের মতো, কিন্তু যা আকৃতিতে সূর্যের ৫০০ গুণ বড়, তাহলে তার পৃষ্ঠের 'এসকেপ ভেলোসিটি' আলোর গতির থেকে বেশি হবে। ১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস একই মতবাদ প্রদান করেন তার ঊীঢ়ড়ংরঃরড়হ ফঁ ংুংঃবসব ফঁ গড়হফ বইয়ে। তবে ১৯৬৯ সালে আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার প্রথম এর নাম দেন বস্ন্যাকহোল। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব দিয়ে ধারণা করেন, বস্ন্যাকহোল থাকা সম্ভব। আর মাত্র ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারিরা প্রমাণ করেন, আসলেই বস্ন্যাকহোল আছে। এটি কোনো সাইন্স ফিকশন নয়। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান যেকোনো তারকা বস্ন্‌্যাকহোলে পরিণত হতে পারে। সত্তরের দশকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও জ্যাকব বেকেনস্টাইন প্রমাণ করেন যে, বস্ন্যাকহোল পুরোপুরি বস্ন্যাক না, অর্থাৎ বস্ন্যাকহোল থেকেও বের হয়ে আশা সম্ভব। আরও পরিষ্কার করে বললে বস্ন্‌্যাকহোল থেকেও শক্তির বিকিরণ হয়। হকিংয়ের নাম অনুসারে একে 'হকিং বিকিরণ' বলে। চলতি বছরের এই প্রিয় বিজ্ঞানীর সবচেয়ে বড় একটি বস্ন্যাকহোলের খোঁজ পান। এধরধ ইঐ৩ নামক তথাকথিত 'স্স্নিপিং জায়ান্ট' এর ভর রয়েছে, যা আমাদের সূর্যের প্রায় ৩৩ গুণ বেশি এবং এটি অ্যাকিলা নক্ষত্রমন্ডলে ১,৯২৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, যা এটিকে পৃথিবীর দ্বিতীয় নিকটতম বস্ন্‌্যাকহোল বানিয়েছে। সবচেয়ে কাছের বস্ন্‌্যাকহোল হলো এধরধ ইঐ১, যা প্রায় ১,৫০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং এর ভর আমাদের সূর্যের প্রায় ১০ গুণ। অবশ্য, এই বড় বড় বস্ন্যাকহোল খুঁজে পাওয়ার ঘটনা প্রথম না। মাঝে মধ্যেই বিজ্ঞানীরা বস্ন্যাকহোল নিয়ে আশ্চর্য সব খবর দেন। সেসব নক্ষত্র এত বড় ছিল যে, তার কাছে আমাদের সূর্যকেই অনেক ছোট মনে হয়। ২০২৩ সালের মার্চে প্রকাশিত বস্ন্যাকহোল আবিষ্কারের খবরে বলা হয়, যে নব আবিষ্কৃত বস্ন্যাকহোলটি এতটাই বড় যে এর মধ্যে ৩০ বিলিয়ন সূর্য জায়গা করে নিতে পারবে। এই বস্ন্যাক হোলটিকে খুঁজে পেতে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়েছে। এটি একটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব মিলিয়ন মিলিয়ন আলোকবর্ষ। এর আকৃতি এত বড় যে একে বলা হচ্ছে 'আল্ট্‌রাম্যাসিভ বস্ন্‌্যাকহোল'। আমাদের মহাবিশ্বে শত কোটি তারা আছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, কোটি কোটি বস্ন্‌্যাকহোলও থাকতে পারে। শুধু আমাদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ, মিল্কি ওয়েতেই, কোটি কোটি বস্ন্‌্যাকহোল থাকতে পারে। শ্বেত বামন থেকে কি সূর্য বস্ন্‌্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারবে? এক কথায় সহজ উত্তর হলো, না। বস্ন্যাক হোলে পরিণত হওয়ার মতো রসদ নেই সূর্যের। তবে ভিন্ন উত্তরও রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের পদার্থবিজ্ঞানী ও কৃষ্ণগহ্বর বিশেষজ্ঞ জেভিয়ার ক্যালমেট। তিনি বলেন, 'এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। বস্ন্যাকহোলে পরিণত হওয়ার মতো ভারী নয় সূর্য।' সূর্যের ব্যাসার্ধ (৮৬৪,৯৫০ মাইল) যদি কমতে কমতে সংকুচিত হয়ে ১.৯ মাইলে পরিণত হয়, তাহলে সূর্যও বস্ন্যাকহোলে পরিণত হবে। সেদিন পৃথিবীর কী হবে? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। যদিও প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। ততদিন না হয় রহস্যেই ঘেরা থাক এ বিষয়টি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে