অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) সারাবিশ্বে একটি বৈশ্বিক হুমকি। মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকই প্রধান ভরসা। তবে, অনেক ব্যাকটেরিয়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সিন্থেটিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্টের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) এএমআরকে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভেষজ ঔষধগুলো সিন্থেটিক ওষুধের বিকল্প হিসেবে নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং সাশ্রয়ী। এ জন্য তারা ভেষজ পরিত্যক্ত পদার্থ নিয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এমতাবস্থায় এন্টিবায়োটিকের বিকল্প উৎস হতে পারে পরিত্যক্ত আমের আঁটি। কারণ, আমে থাকে বিভিন্ন ধরনের ম্যাক্রো ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। আমের খোসা ও বীজের কার্নেল ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন হলেও সাধারণত এই অংশগুলো পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়।
তবে পরিত্যক্ত আমের বীজ বা আমের আঁটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণের গবেষণায় প্রাথমিক সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। আমের আঁটির গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন ও তার গবেষক দল এই সাফল্য পেয়েছেন। আমের আঁটির বীজের নির্যাস থেকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান মানবদেহ ও পশু-পাখিতে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন ওই গবেষক।
ড. গোলজার জানান, নিজস্ব অর্থায়নে গবেষণাটি শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। সে সময় বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপন্ন হয় এবং এর বীজগুলো সাধারণত পরিত্যক্ত হয়। তাই আমরা দেশি জাতের আমের বীজের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আমের পরিত্যক্ত বীজ থেকে একটি নির্যাস তৈরি করি, গ্রাম পজিজিভ ব্যাকটেরিয়াসহ আরও কিছু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইঁদুরে সেই নির্যাস পরীক্ষার সময় দেখা গেছে, এই নির্যাসের বিষাক্ততা নেই বললেই চলে এবং উচ্চ মাত্রায় এই নির্যাস প্রয়োগে ইঁদুরগুলোর লিভার ও কিডনিতে সামান্য পরিবর্তন দেখা গেলেও, উলেস্নখযোগ্য কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা যায়নি। স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, আমের বীজের নির্যাস ব্যাকটেরিয়ার কোষের গঠন ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি বায়োফিল্মও ধ্বংস করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইঁদুরের ওপর এই নির্যাস প্রয়োগে ওই সংক্রমিত ইঁদুরগুলো দ্রম্নত সুস্থ হয়ে উঠে।
উক্ত গবেষণা কার্যক্রমের সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকুমার সাহা, ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন আক্তার, কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. বিপস্নব কুমার সাহা, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী রাহীলা জান্নাত সাদিয়া, চন্দন সিকদার, আনন্দ মজুমদার, মোসলেমা জাহান মৌ এবং নাজমুল হাসান সিয়াম।
আমের আঁটি থেকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান তৈরির বিষয়ে ড. গোলজার বলেন, যেসব ব্যাকটেরিয়া গ্রাম নেগেটিভ, সেসব ব্যাকটেরিয়ার ওপর এর কার্যকারিতা তেমন নেই। এর অর্থ এই ক্রুড নির্যাসটির মধ্যে এমন কোনো কিছু আছে, যা কিনা এই ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করেছে। আমের আঁটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে আমরা পোলট্রিতে এই নির্যাস প্রয়োগের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। যদি সফল হই, এটি বাংলাদেশের পোলট্রি সেক্টর ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান অবদান রাখবে এবং অর্থনৈতিক সাশ্রয় সাধিত হবে, যা জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক হবে।