বলা হয়ে থাকে বেবী নাজনীন শিশু বয়সেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই ঢাকায় পা রাখেন। ছিলেন মফস্বল শহরে। সেখান থেকে জিয়াউর রহমানই প্রথম বেবী নাজনীনকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই থেকে বেবী তার গানের পাশাপাশি নিজেকে রাজনীতিতেও জড়িয়ে ফেললেন জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বেবীকে দীর্ঘ আট বছরের প্রবাস জীবন কাটাতে হয়।
আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়ত জানেন না এই সঙ্গীত শিল্পীর ক্যারিয়ারে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অবদান কতটুকু। জিয়াউর রহমান তাকে যদি সেদিন ঢাকায় না নিয়ে আসতেন তাহলে তার গানের ভবিষ্যৎও কেমন হতো জানা নেই। তখন তো আর আজকের মতো গানের রিয়েলিটি প্রতিযোগিতার আসর ছিল না। প্রতিভা খোঁজারও কোনো পথ ছিল না।
জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ঢাকায় আসার ব্যাপারে বেবী নাজনীন বলেন, 'রংপুর থেকে আমার ঢাকায় আসার গল্পটা অন্য রকম। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তখন উত্তরবঙ্গে খাল কাটতে গিয়েছিলেন। খালকাটা কর্মসূচি চলছিল। তিনি উলিপুর-কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় খালকাটা কর্মসূচি শেষ করে রংপুরে এসেছেন। তার সম্মানার্থেই আয়োজন করা হয় সঙ্গীত অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে আমি গান গাই। আমার গান শুনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুগ্ধ হন। এরপর বলেন, তোমাকে বড় শিল্পী হতে হবে। তোমার রংপুরে থাকলে চলবে না। এখানে থাকলে তুমি বড় শিল্পী হতে পারবে না। এরপর তিনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। যদিও আমি আরও আগে জাতীয় পুরস্কার নিতে ঢাকায় এসেছি, তবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন স্থায়ীভাবে।'
এভাবেই সেদিনের শিশু বেবী নাজনীনের মনের কোণায় জিয়াউর রহমানের রাজনীতিতেও ঢুকে পড়লেন তার প্রতি ভালোবাসার টানে। এই রাজনীতি নিয়েও বেবী নাজনীন কথা প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি গানের মানুষ। আবার যারা অনেক মানুষকে বিনোদিত করতে পারে, তাদের এক ধরনের দায়বদ্ধতাও তৈরি হয়। সেই দায়বদ্ধতা হলো তাদের জন্য কিছু করা। আর এজন্য কিন্তু একটা পস্ন্যাটফর্ম দরকার হয়। সেটাই হলো রাজনৈতিক। আমার রাজনৈতিক পস্ন্যাটফরম হলো জাতীয়তাবাদী দল। আমি মানুষের জন্য আবার গান করব, আবার মানুষের সেবার জন্যও নিজেকে নিয়োজিত করব। আমি দেশে ফিরেছিই আমার মানুষের কথা ভেবে, আমি তাদের পাশে আছি, গানে ও প্রাণে।'
অর্থাৎ বেবী নাজনীন শুধু গানের শিল্পীই নন, সেদিনের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার হৃদয়ে এমনি দাগ কেটে গেছেন যে, তাকে ছাড়া তিনি তার গানের জগৎকে ভাবতেই পারেন না। তার এই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গভীর বিশ্বাসের। সেজন্যই এই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে বিগত সরকারের আমলে পেশাগত কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সঙ্গীতশিল্পী বেবী নাজনীনের।
পরবর্তী সময়ে তিনি থিতু হন যুক্তরাষ্ট্রে। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর পর দেশে ফিরেছেন বেবী নাজনীন। দেশে ফিরে তিনি বলেন, 'শিল্পীরা সব সময় দলমতের ঊর্ধ্বে, তাদের কখনোই কোনো বাধানিষেধের মধ্যে রাখা যাবে না।'
যেদিন সকালে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখেন বেবী নাজনীন সেদিন তাকে স্বাগত জানান ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীরা। স্স্নোগানে স্স্নোগানে তাকে স্বাগত জানান তার সমর্থকরা। তবে তাদের কারও হাত থেকেই ফুলের তোড়া গ্রহণ করেননি বেবী নাজনীন। জানিয়েছেন, ফুল নয়, কেবল শুভেচ্ছাই যথেষ্ট। বেবী নাজনীন শুরুতেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে নিহত সব শহীদ ও আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
দীর্ঘ সময় পর দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় বেবী নাজনীন বলেন, 'বিমান থেকে নেমেই বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়েছি। যে নিঃশ্বাসটা অতি আদরের, গভীর ভালোবাসার। এটা বহুদিন পাইনি। এই না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কী, সেটা আজকে পাওয়ার পরে আরও বেশি বুঝতে পারছি!'
বেবী নাজনীন বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বৈরাচারের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে ছাত্র-জনতা, তাদের সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সবাইকে। স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি তারেক রহমানের নেতৃত্বে সবাইকে কাজ করতে হবে।
অন্তর্র্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে বেবী নাজনীন বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকারে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি রয়েছেন, এতে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। পাশাপাশি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার আরোগ্য ও তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে বারবার বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয় বেবী নাজনীনের সঙ্গীত জীবন। বাংলাদেশ বেতার, টিভি ও মঞ্চ, কোনো মাধ্যমেই গায়িকা স্বাচ্ছন্দে কাজ করতে পারেননি। একপর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এই বস্নাক ডায়মন্ড। তবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে বেবী নাজনীন সব সময়ই সমাদৃত। ফলে বিদেশের মাটিতে তার কাজকর্মে কোনো বাধা আসেনি, বরং এ সময়ে আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বস্নাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীন।
উলেস্নখ্য, সাড়ে চার দশকের ক্যারিয়ারে আধুনিক সঙ্গীতের অর্ধশতাধিক একক অডিও অ্যালবামসহ অসংখ্য দ্বৈত অডিও অ্যালবামে গান গেয়েছেন তিনি। ভারতের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আশা ভোঁশলে, বাপ্পি লাহিড়ী, কুমার শানু, কবিতা কৃষ্ণমূর্তির সঙ্গেও একাধিক অডিও অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে তার। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণির তালিকাভুক্ত শিল্পী বেবী নাজনীন চলচ্চিত্র, অডিও'র মাধ্যমে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন।
তবে বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণেই বেবী নাজনীনসহ দেশের অনেক নামকরা শিল্পী ছিলেন যারা কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন। এ বিষয়ে বেবী নাজনীন আক্ষেপ করে বলেন, 'শিল্পীদের জন্য এটা দুঃখজনক। কালো রাত্রি, কালো দিবস বা কালো ইতিহাস বলা যায়। শিল্পীরা দেশের মুকুট। তারা সব সময় সম্মানের। সংস্কৃতির মাধ্যমে শিল্পীরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। শিল্পীরা সব সময় দলমতের ঊর্ধ্বে। বিশেষ কোনো দলের সমর্থক বলে তাদের এড়িয়ে চলতে হবে- এমনটা আমি চাই না।'
ভবিষ্যতে আবারও কালো তালিকা তৈরি হবে কিনা- জানতে চাইলে বেবী নাজনীন বলেন, 'শিল্পীদের কোনো বাউন্ডারি থাকতে নেই। শিল্পীদের কখনোই কোনো বাধানিষেধের মধ্যে রাখা যাবে না। আমি সব সময় এই শব্দের বিরুদ্ধে। সঙ্গীত একটা পরিচ্ছন্ন বিষয়। শিল্পীরা যখন একে বহন করবেন, তখন নেতিবাচক দিকগুলো বর্জন করতে হবে। কালো তালিকা শব্দটাই তো খারাপ। আমি কেন এই শব্দটি লালন করব। বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছে, এখানে কালো তালিকা শব্দটি যেন আর না আসে। আমি শিল্পী, আমি প্রাণখুলে গাইব। আমি কেন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ব, কেন আমাকে নিয়ে রাজনীতি হবে। এসব নোংরামির কারণে শিল্পীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন।'
তবে দেশের বাইরে থাকলেও রাজনীতিতে তিনি বরাবরই সক্রিয় থেকেছেন বেবী নাজনীন। গত জুন মাসে বেবী নাজনীনকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়। বিমানবন্দরে তিনি জানান, এখনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। ভবিষ্যতে দলীয় নির্দেশনা মেনেই কাজ করবেন। তবে গান নিয়েও পরিকল্পনা আছে তার। বেবী নাজনীন বলেন, 'অনেক নতুন গান প্রস্তুত আছে। শিগগিরই সেগুলো রেকর্ড হবে। মাত্রই ত বাংলাদেশে এলাম, তাই একটু সময়ের প্রয়োজন। তবে, আমি এখন কনসার্ট করব। সামনে থেকে আমার ভক্তদের দেখব। আমার ইচ্ছামতো তাদের সামনে গাইব।' এবার বিজয় দিবসের কনসার্টেও মূল আকর্ষণ থাকছেন বেবী নাজনীন।
বোঝাই যাচ্ছে, বেবী নাজনীন বর্তমানে আদিগন্ত খোলা মাঠের ফড়িংয়ের মতো উড়ছেন। এখন নতুন এক চাপমুক্ত বাংলাদেশকে পেয়েছেন। যেখানে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়। তাই বলতে পারছেন, 'সামনে থেকে আমার ভক্তদের দেখব। আমার ইচ্ছামতো তাদের সামনে গাইব।'