শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রঙিন নবাব প্রবীর মিত্র

তারার মেলা ডেস্ক
  ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
রঙিন নবাব প্রবীর মিত্র
রঙিন নবাব প্রবীর মিত্র

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে অভিনেতাদের জন্য গর্ব করতে পারে তাদের মধ্যে একজন কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীর মিত্র। প্রায় পাঁচ দশকের অভিনয় জীবনে অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রবীর মিত্রের নামটি উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে অসংখ্য চরিত্রের ছবি ভাসে। তিনি কখনো বাবা, ভাই, ছেলে, বন্ধু, পুলিশ অফিসার, ধনী, গরিব, জমিদার, একতারা-দোতারা হাতে শিল্পী, সন্তানহারা পাগল কিংবা হক মওলা জপতে থাকা চরিত্রও করেছেন। বহুমুখী চরিত্রের অসাধারণ একজন অভিনেতা। মঞ্চ যার ব্যাকগ্রাউন্ড তার তো এমনই হওয়ার কথা। অনেক চরিত্রে নিজের আইডেনটিটি তৈরি করতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

সেই রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেনদের নায়ক আমল থেকে শুরু করে ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাভেদ, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, সালমান শাহ পরবর্তী রিয়াজ, শাকিল খান, ফেরদৌস, শাকিব খান হয়ে কাজী মারুফ পর্যন্ত তিনি অনেক নায়কের সঙ্গে পর্দা ভাগ করেছেন নিজের পারফরম্যান্সে। এই বিশাল কর্মপরিধি তাকে কিংবদন্তি বানিয়েছে। প্রবীর মিত্রের অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বড় শক্তি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ। দূর থেকে শুনলেও বোঝা যাবেও প্রবীর মিত্রেরই ভয়েস। আবৃত্তির জন্য এ ধরনের ভয়েস খুব কার্যকরী হয়। জন্ম ১৮ আগস্ট, ১৯৪৪, চাঁদপুর। জমিদার বংশের সন্তান ছিলেন। পুরনো ঢাকায় শৈশব কাটে। স্কুলে নাটক করতেন অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ডাকঘর' নাটকে প্রায় সব চরিত্রে প্রক্সি দিতে হয়েছিল তাকে এবং এখান থেকেই অভিনয়ের নেশা পাকাপোক্তভাবে পেয়ে বসে তাকে। ক্লাস টু-তে তার বন্ধু ছিলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় ১৯৬৮-তে পরিচালক এইচ আকবরের 'জলছবি' ছবিতে। ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল একজন শিল্পীর অনুপস্থিতিতে। এ টি এম শামসুজ্জামানের স্ক্রিপ্টে 'জীবনতৃষ্ণা' ছবিতে 'এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে' গানটিতে তিনি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর তার ক্যারিয়ার এগিয়ে যেতে থাকে।

1

বেশ কিছু ছবিতে নায়ক এবং প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রবির মিত্রের অসংখ্য ছবির মধ্যে উলেস্নখযোগ্য কিছু : জলছবি, জীবনতৃষ্ণা, পুত্রবধূ, জয় পরাজয়, দেবদাস, তিতাস একটি নদীর নাম, সেয়ানা, অঙ্গার, রামের সুমতি, নয়নের আলো, রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, আশ্রয়, বাল্যশিক্ষা, ফকির মজনু শাহ, মৌচোর, প্রতিজ্ঞা, গাঁয়ের ছেলে, মধুমিতা, বড় ভালো লোক ছিল, জন্ম থেকে জ্বলছি, চ্যালেঞ্জ, চরিত্রহীন, ঝিনুক মালা, মানসম্মান, ফেরারী বসন্ত, নাজমা, আঁখি মিলন, মান অভিমান, আশীর্বাদ, প্রিন্সেস টিনা খান, সোহেল রানা, জারকা, পরিণীতা, মিস লোলিতা, বেদের মেয়ে জোচ্ছনা, যোগাযোগ, গাড়িয়াল ভাই, দোষী, রাজার মেয়ে পারুল, বদসুরত, রাজাজনি, বিশ্বাস অবিশ্বাস, প্রেমযুদ্ধ, আজ গায়ে হলুদ, প্রিয়া আমার প্রিয়া, ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না, সোনার ময়না পাখি, দেহরক্ষী।

তার চরিত্রাভিনেতা হিসেবে উলেস্নখযোগ্য কিছু ছবি আছে। 'রঙিন নবাব সিরাজউদ্দৌলা' ছবিতে তিনি আনোয়ার হোসেনের নবাব চরিত্রটি করেছিলেন। পরিচালক প্রদীপ দে-র প্রস্তাবে তিনি প্রথমে কোনোভাবেই রাজি ছিলেন না- কারণ আনোয়ার হোসেন তার কাছে গুরু ছিলেন। এফডিসিতে একদিন তাকে বললেন চরিত্রটি করার জন্য পরিচালক চাপ দিচ্ছেন। আনোয়ার হোসেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে চরিত্রটি করতে বলেন।

তার কাছে সাহস পেয়ে তিনি রিমেক ছবিটিতে প্রধান চরিত্র করলেন এবং এটিও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল দর্শকের কাছে। প্রবীর মিত্রের কণ্ঠেও 'বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব' সংলাপগুলো বলিষ্ঠ ছিল এবং অভিনয়ও অনবদ্য ছিল।

'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে তার তেজোদ্দীপ্ত লুক ছিল। কবরীকে কোলে করে নিয়ে যাওয়ার যে শটটি আছে ওই দৃশ্যে তাকে অনবদ্য লাগে দেখতে। 'নয়নের আলো' ছবিতে জাফর ইকবালের বন্ধুর চরিত্রটি ছিল অসাধারণ। 'আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন' গানটিতে জাফরের পাশাপাশি প্রবীর মিত্রের অভিনয়ও উলেস্নখ করার মতো। 'বড় ভালো লোক ছিল' ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন। এ ছবিতে 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুশ' গানটিতে প্রবীর মিত্রের অভিনয়ই সবচেয়ে ফোকাসে ছিল। এই ছবিতেই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৮২ সালে।

জীবনাবসান ঘটেছে রুপালি পর্দার 'রঙিন নবাব' প্রবীর মিত্রর। বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগে রবিবার রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান প্রবীর মিত্র। জীবনপ্রদীপ নেভার পর শেষবারের মতো তিনি এসেছিলেন তার প্রিয় কর্মস্থল এফডিসিতে, যেখানে তার জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছিলেন। অন্যান্য সময়ে শুটিংয়ে এলেও এদিন তিনি এসেছিলেন কফিনে করে, নিথর দেহে। এফডিসির জহির রায়হান ভিআইপি প্রজেকশনের সামনে অভিনেতার প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয়। প্রবীর মিত্রকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে এফডিসিতে এসেছিলেন তার সহকর্মীসহ নবীন-প্রবীণ চলচ্চিত্রকর্মীরা। উপস্থিত ছিলেন চিত্রনায়ক আলমগীর, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, নির্মাতা ছটকু আহমেদ, খোরশেদ আলম খসরুসহ অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রী ও এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর তাকে দাফন করা হয় আজিমপুর গোরস্তানে। অনেকটা অভিমান করেই যেন চলে গেলেন প্রবীর মিত্র। বছর দু-এক আগে যখন গণমাধ্যমের সঙ্গে তার কথা হচ্ছিল, তখন তার কণ্ঠে ঝরছিল অনেক অভিমান। সে সময় তিনি বলেছিলেন, 'কেউ আমার খবর নেয় না। যেন কারোরই খবর নেওয়ার দরকার নেই। শুধু ভাবি, কেউই তো আমার খোঁজ নেয় না। আমিও কারও খোঁজ নিই না। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে জীবনটা।' কয়েক বছর ধরে হাঁটুর হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছিলেন। মাঝে অস্ত্রোপচার করা হলেও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি, রুটিন মাফিক ফিজিওথেরাপি নিতে হতো তার। স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারতেন না, চলাচলের জন্য তার ভরসা ছিল হুইলচেয়ার।

প্রবীর মিত্র প্রেমিকার জন্য হয়েছিলেন ধর্মান্তরিত। সনাতন ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন এই অভিনেতা। এক সাক্ষাৎকারে প্রবীর মিত্র নিজেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। সে সময়ের ভিডিওতে প্রবীর মিত্রকে বলতে শোনা যায়, 'আমি তো কনভার্ট হয়েই ওর মাকে (স্ত্রী) বিয়ে করেছিলাম। তখন মুসলমান হয়েছিলাম। তখন প্রয়োজন হয়েছিল মুসলমান হওয়া, এখনো সে ধর্মেই আছি। সেই সাক্ষাৎকারে প্রবীর মিত্র জানিয়েছেন তার কষ্টের কথা। বলেছেন, অভিনয় করতে না পারলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি অভিনয় করতে পারছি না, এটাই আমার বড় কষ্ট। অভিনয়টা আমাকে খুব টানে। অপেক্ষায় আছি, সুস্থ হয়ে আবার অভিনয়ে ফেরার। কিন্তু এ অভিনেতার আর অভিনয়ে ফেরা হলো না। ভিডিওতে সহকর্মীদের কথাও বলেছিলেন অভিনেতা। জানিয়েছেন, অনেকেই তার খোঁজখবর নেন। সবাই তার জন্য দোয়া করেন। তিনিও সবার জন্য দোয়া করেন, সবাই যেন ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে ধর্ম নিয়ে জানতে চাইলে প্রবীর মিত্র জানান, বিয়ের সময় মুসলমান হিসেবে কনভার্ট হয়েই বিয়ে করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই মাঝে খবর ছড়ায় প্রবীর মিত্র মুসলমান হয়েছেন। তবে ধর্ম নিয়ে প্রবীর মিত্রের ভাবনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধর্ম নিয়ে আমার কোনো বাড়াবাড়ি নাই। 'সবার ওপরে মানুষ সত্য তার ওপরে নাই।' মানুষ সবার ওপরে।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮২ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত 'বড় ভালো লোক ছিলো' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান প্রবীর মিত্র। আর ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। ব্যক্তি জীবনে তার তিন ছেলে, এক মেয়ে। স্ত্রী অজন্তা মিত্রকে ২০০০ সালে হারানোর পর ২০১২ সালে তার ছোট ছেলে আকাশও পরপারে পাড়ি জমান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে