সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঈদগাঁওয়ে ফুলেশ্বরী নদীর করাল গ্রাসে বিলীনের পথে গজালিয়া গ্রাম

ঈদগাঁও (কক্সবাজার) প্রতিনিধি
  ৩১ মে ২০২৫, ১৫:২৪
ঈদগাঁওয়ে ফুলেশ্বরী নদীর করাল গ্রাসে বিলীনের পথে গজালিয়া গ্রাম
ফুলেশ্বরী নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পথে গজালিয়া গ্রাম । ছবি: যায়যায়দিন

ফুলেশ্বরী নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার পথে গজালিয়া গ্রাম। পটে আঁকার ছবির মত অনিন্দ্য সৌন্দর্যের পসরা সমৃদ্ধ ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন দিন কাটাচ্ছে বাস্তুচ্যুত হওয়ার চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ নিয়ে ।

চলতি বর্ষা মৌসুমে ফুলেশ্বরী নদীর ভাঙ্গনপ্রতিরোধে কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা না নিলে পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে পড়বে ওই গ্রামের শতাধিক পরিবারের। এতে হাজারো মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

1

ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের সর্বপূর্বের একাংশ পাহাড় ও অপর অংশ নদীবিধৌত উর্বর পলিগঠিত সমভুমিবেষ্টিত গজালিয়া গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, খরস্রোতা ফুলেশ্বরী নদী গ্রামটির পুর্ব ও পশ্চিমাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দু'পাশেই লোকালয় ও বিস্তীর্ন ফসলী জমি। নদীর পূর্বতীর ঘেঁষেই শতবছর ধরে বসবাস করছে শতাধিক পরিবার। কৃষিই যাদের প্রথম এবং প্রধান পেশা। এঁদের শ্রমেঘামে উৎপাদিত ও সরবরাহকৃত সবজি উপজেলার সিংহভাগ কাঁচা সব্জির চাহিদাপূরণ করে।

গুণেমানে উৎকৃষ্ট, দ্রুত বাজারজাতকরণ এবং বিপুল পরিমাণ সবজি উৎপাদনের কারণে গ্রামটি ঈদগাঁও উপজেলার " সবুজ সবজির ঝুড়ি " নামে খ্যাত।

গজালিয়া গ্রামের ভাঙন কবলিত অংশটি যেমন অস্তিত্বসংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি নদীর পশ্চিম পারে ঝুঁকির মুখে আছে ভোমারিয়াঘোনা ফরেস্ট অফিসটিও। নদীর এই অংশে নেই কোন বেড়িবাধ কিংবা বন্যাপ্রতিরোধ ব্যবস্থা।

ভাঙ্গনকবলিত কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিগত ৭/৮ বছর ধরে প্রতিবছরই নিয়মিতভাবে তারা বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙ্গনের ফলে তাদের অনেক জমি জিরাত,ঘরভিটা, উঠান, গোয়ালঘর'সহ বহু স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীপার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নদী এসে পড়েছে অনেকের ঘরের বারান্দায়। মাথা গোঁজার শেষসম্বলটুকুও যেকোন মুহুর্তে পরিণত হতে পারে নদীর করাল গ্রাসে।

ভয়ঙ্করভাবে নদীভাঙ্গনের শিকার আজিজুল হক সিকদারের ঘরভিটায় গিয়ে দেখা গেছে, উঠানের বড় একটি অংশ নদীর গর্ভে বিলীন। তাঁর ঘরের বারান্দার কাছেই নদীভাঙ্গনের নীরব সাক্ষী হয়ে বিশাল বিশাল ভূমিধ্বস ও খাদ। নদী ও ঘর এই দুইয়ের মধ্যখানে একটি বড়সড় বাঁশঝাড় ভাঙ্গনের মুখে রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই বাঁশঝাড়টির কিছু অংশও নদীর তলদেশে দৃশ্যমান।

ভিটেমাটি রক্ষার দু:শ্চিন্তা ও হতাশায় পরপর দু'বার হৃদরোগাক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত গৃহকর্তা আজিম মাতবর।

ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নদীর ওপারে ( পশ্চিম দিকে) জেগে উঠা চরের দিকে আঙুলি নির্দেশ করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন, এখান থেকে ঠিক ২০০ মিটার দূরে ছিল আমাদের আদি ভিটা। তারপরেই ছিল ফুলেশ্বরী নদী। বছরের পর বছর ধরে চলা

ভাঙ্গনতাণ্ডব আর প্রলয়ঙ্করী মৌসুমি বন্যায় নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করে একবারে ঘরের দাওয়ায় চলে এসেছে। আরেক দফা ভাঙ্গন বা অতিবৃষ্টিজনিত পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হলে মাথাগোঁজার অবশিষ্ট অংশটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তাঁর বাড়ির পাশে মসজিদ ও মাদরাসা প্রাঙ্গণের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি আরো বলেন, নদী যেভাবে আমাদের লোকালয়কে করালগ্রাসে পরিণত করেছে তাতে এই প্রতিষ্ঠানগুলিও অস্তিত্বসংকটের মুখে।

গজালিয়া গ্রামের আজিম মাতবরের পরিবারের মত আরো শতাধিক পরিবার আছে, যারা চরম ঝুঁকি ও আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার জুয়েল বলেন, ফুলেশ্বরী নদী আমাদের জন্য আশীর্বাদ হলেও এই ওয়ার্ডের নদীপারে বসবাসরত মানুষের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

নদীস্রোতের দিক পরিবর্তন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান,সরকারী সহায়তা পেতে বিলম্ব হলে সামাজিক উদ্যোগে স্পার নির্মাণ করে হলেও এই লোকালয়কে বাঁচাতে হবে।

বন্যা, নদীর হাইড্রোলজিক্যাল ও মর্ফোলজিক্যাল পরিবর্তন, ফুলেশ্বরীর নদীর ভাঙন বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ( বাপা) ঈদগাঁও উপজেলার সভাপতি সাংবাদিক ও সংগঠক কাফি আনোয়ার বলেন, ফুলেশ্বরী নদীটি লুট হয়ে গেছে আগেই, আর এখন সবাই মিলে এই নদীকে গলা টিপে হত্যা করছি।নিজের লুট হওয়া প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ও জীব বৈচিত্র‍্যতা পূনরুদ্ধার করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার লড়াই করে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে নদীটি।

নদী ভাঙ্গন, বন্যা, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এসবই মানবসৃষ্ট নদীনিপীড়ণের দীর্ঘসুত্রি ফলাফল। অবৈধ বালি উত্তোলন সহ নদীলুট ও নদীনিপীড়ণ বন্ধ হলে ফুলেশ্বরী তার স্বত:চ্ছল রূপলাবণ্যে ফিরে আসবে এবং বন্যা, ভাঙন ও গতিপথ পরিবর্তনও বন্ধ হয়ে যাবে।

ঈদগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিমল চাকমা জানান, বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাভুক্ত তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে দ্রুত কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থাগ্রহণের মাধ্যমে বন্যানিয়ন্ত্রণ ও লোকালয় রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে