নীলফামারীর সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় দেড়শ’ কোটি টাকার বেশি চলমান প্রকল্পের বড় অংশ এখনও সাবেক রেলপথ মন্ত্রী সুজনের আত্মীয় এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনেক নেতা ও তাদের স্বজনদের দৃশ্যপটে কম দেখা গেলেও রেলওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে তাদের আধিপত্য এখনো বহাল রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় তালিকাভুক্ত ঠিকাদার আছে ৭৩টি। এরমধ্যে সৈয়দপুরের রয়েছে অন্তত ১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান । অথচ, গত ১৭ বছর ধরে অধিকাংশ কাজ পাচ্ছে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে তারা প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে অনেক প্রকল্পেই রয়েছে দরপত্র ছাড়া কাজ দেওয়ার অভিযোগ।
যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কাজ পাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের ভাগনে ও ভাতিজা, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা আফসার বিশ্বাস (এরিয়ান বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্বাস কনস্ট্রাকশন) এবং রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আত্মীয়।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় রেলওয়ের কাজ সাধারণত উন্মুক্ত দরপত্র এবং লোকাল টেন্ডার মেথডে (এলটিএম) করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী উন্নয়নকাজের একটি প্যাকেজের চুক্তিমূল্য ৩৫ কোটি টাকার বেশি এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজের ক্ষেত্রে ১৫ কোটি টাকার বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্রে করা হয়। এছাড়া ১৫ কোটি টাকার কম হলে এলটিএমে করা হয়। রেলওয়ের বিধি অনুযায়ী, ১৫ কোটি টাকার কম কাজ এলটিএম পদ্ধতিতে ও বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
তবে এখানে প্রায় ৮০ কোটি টাকার কাজ দরপত্র ছাড়াই বিতরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়েরই কয়েকজন কর্মকর্তা।
সূত্রটি আরও জানায়, কাজগুলো করছে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের রাজশাহী মহানগর কমিটির নেতা আফসার বিশ্বাসের মালিকানাধীন এরিয়ান বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিশ্বাস কনস্ট্রাকশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগের সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের ভাগনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঠাকুরগাঁও জেলা শাখার সভাপতি মো. নাজমুল হুদা শাহ্ অ্যাপোলো ও ভাতিজা সাজু এবং রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এক আত্মীয়।
এছাড়া গত কয়েক বছরে তাদের অন্তত ৮০ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে বিনা দরপত্রে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার এবং রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই ঠিকাদারদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় রেলওয়ের সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। কাজ নিয়ে তাদের কেউ-কেউ ৫ শতাংশ কমিশনে তৃতীয় পক্ষের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে প্রকৃত পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
রেলওয়ে কারখানার কর্মরত কয়েকজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অর্থের বিনিময়ে এবং স্থানীয় কয়েকজনের সুপারিশে ঘুরে-ফিরে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো রেলওয়ের কাছ থেকে স্ক্র্যাাপ মালপত্র (অচল যন্ত্রাংশ) হিসেবে স্বল্পমূল্যে কিনে স্থানীয়ভাবে মেরামত করে রং করে বেশি দামে আবারও রেলের কাছেই বিক্রি করছে।
তারা জানান, ২০১৭ সালে ১৫৩ কোটি টাকায় আধুনিকায়নের নামে যেসব টিন বসানো হয়েছিল, তার মান এতো খারাপ যে এখনই পানি পড়ে শেডের ভেতর ভিজে যাচ্ছে। নতুন বসানো অনেক মেশিনও নষ্ট হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলের টিন, মেশিন এখনও ঠিক আছে। কিন্তু নতুন করে যা’ লাগানো হলো, তা’ কয়েক বছরের মধ্যেই বিকল হয়ে গেছে। এটি স্পষ্ট অনিয়ম।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সংবাদকর্মীরা ওই ঠিকাদারদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও না পাওয়ায় মন্তব্য মেলেনি।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) শাহ সুফি নুর মোহাম্মদ সংবাদকর্মীদের জানান, আমি এখানে সদ্য যোগ দিয়েছি। আগের প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত আমার জানা নেই।