রোববার, ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২
প্রাইমারী স্কুল-মাদ্রাসা ১৪ বার ভাঙনের কবলে

যমুনার ভাঙনের আশঙ্কায় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক পরিবার

জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল, টাঙ্গাইল
  ১৫ জুন ২০২৫, ১৪:২১
যমুনার ভাঙনের আশঙ্কায় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক পরিবার
যমুনার ভাঙন হুমকিতে টাঙ্গাইলের তীরবর্তী এলাকা: ছবি যায়যায়দিন

জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝিতে যমুনায় বর্ষার পানি বাড়লেও আষাঢ়ের কমতে শুরু করেছে। যমুনার চিরায়ত রীতি অনুযায়ী ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ শতাধিক পরিবার।

ভাঙন আতঙ্কে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাকুয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ গয়লা হোসেন দাখিল মাদ্রসা, ডেকিয়া বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ গয়লা হোসেন নুরানি মাদ্রাসা এবং দক্ষিণ গয়লা হোসেন জামে মসজিদ, দক্ষিণ গোলাশন কবরস্থান এবং আব্দুল মান্নান সেতু।

1

জানা যায়, যমুনায় পানি বাড়লে ভাঙে এবং কমলেও তীরে ভাঙন শুরু হয়। টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কাকুয়া ইউনিয়নের ঝাউগাড়া থেকে ওমরপুর দক্ষিণপাড়া পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে যমুনার ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই বাড়ি-ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে।

সরেজমিনে স্থানীয়রা জানায়, প্রায় ৫৩ বছর আগে দক্ষিণ গয়লা হোসেন দাখিল মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় মহিয়সী নারী মরহুম খায়রুন নেছা। সে সময় থেকে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যমুনার করাল গ্রাসের শিকার হয় ১৪ বার।

প্রতিবারই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে মাদ্রাসাটি ওমরপুর গ্রামে অবস্থিত। সেখানেও ভাঙনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। একই এলাকার শিক্ষানুরাগী মৃত হাছেন হাজী ডেকিয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও ১৫ থেকে ১৬ বার যমুনা নদীর পেটে চলে যায়। বর্তমানে সেটাও ওমরপুরে অবস্থিত। সেখানেও ভাঙন আতঙ্ক দেখা দেওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।

প্রতি বছর বর্ষায়ই যমুনার বামতীরে ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙন প্রতিরোধে স্থানীয়রা প্রশাসনের নজর কাড়তে শুকনো মৌসুমে প্রতি বছরই মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে থাকে। কিন্তু প্রশাসনের কাছে বরাবরই অবহেলিত এতদাঞ্চলের মানুষ।

স্থানীয় আমিরুল ইসলাম নামে ৯০ বছরের এক বয়োবৃদ্ধ জানান, তিনি পাচবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। বর্তমানে ওমরপুর গ্রামের যমুনার তীরে জনৈক ব্যক্তির জমি লিজ নিয়ে বাড়ি তৈডির করে বসবাস করছেন। সে বাড়ি-ঘরও এবার ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে। বাড়টি ভেঙে গেলে অন্যত্র বাড়ি তৈরি করার মতো জায়গা-জমি তার নেই।

তিনি জানান, ওমরপুর গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ যমুনার ভাঙনের শিকার। তাদের পূর্ব পুরুষরা যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন। বর্তমানে ওমরপুর গ্রামে যারা বসবাস করছেন তারা প্রায় সবাই ভিটা-মাটি হারা। তাদের পূর্বপুরুষরা এক সময় শ’ শ’ বিঘা জমির মালিক ছিলেন।

স্থানীয় আবুল হোসেন জানান, তার বাবা সহ তিনি ১৩ বার যমুনার করালগ্রাসের শিকার হয়েছেন। একটা পরিবার ১৩ বার নদী ভাঙনের শিকার হলে তার আর কি থাকে?

তিনি জানান, এবার ভাঙনের কবলে পড়লে আর কোনো উপায় নাই। বাড়ি সরিয়ে অন্যত্র নেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা তার নেই। মানুষ এখন লাভের উপর জায়গা দিতে চায়না। নদী ভাঙা মানুষ জায়গা-সম্পত্তি কেনার মত সামর্থ না থাকায় তারা লাভের উপর জায়গা লিজ নিয়ে বাড়ি-ঘর তৈরি করে বসবাস করে থাকেন।

বাড়ি-জমি ভেঙে যাওয়া যমুনা নদীতে শুকনো মৌসুমে বাদামের চাষ করেন। ফলে যমুনা নদীর কিনারেই তারা বসবাস করেন।

তিনি আরও জানান, যমুনা নদীতীরের মানুষ দূরে কোথাও কোন জায়গা কেনার সামর্থ্য না থাকায় স্থায়ী বাড়ি-ঘর করতে পারে না। তারা নদীতীরে অন্য মানুষের জায়গা ভাড়া চুক্তিতে লিজ নিয়ে বসবাস করেন। যে কারণে তারা প্রতিবছরই নদী ভাঙনের কবলে পড়েন।

দক্ষিণ গয়লা হোসেন গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল বাতেন জানান, যমুনা নদীর ভাঙনে তার নানার বংশধররা ছড়িয়ে ছিটে পড়েছে। তার নানার অনেক জমি ছিল। সব জমি যমুনার পেটে চলে গেছে।

তিনি মায়ের কাছে শুনেছেন, তার নানার বাড়ি ১৪ বার ভেঙেছে। নানার বাড়ি সবশেষ সরমা গ্রামে নদী ভাঙনের ফলে তারা ১৫ বারে টাঙ্গাইল শহরে গিয়ে বাড়ি করেছেন।

তার নানা মারা যাওয়ার পর মা-খালারা তিনজন প্রত্যকেই ১০০শ’ বিঘা করে জমি পেয়েছিল। সে জমিও আজ যমুনার পেটে।

ওমরপুর গ্রামের আইয়ুব আলী জানান- এতদাঞ্চলের পানাকুড়া, কেশবমাইজাল, চরপৌলি, উত্তর চরপৌলি, নয়াপাড়া, দশাখা, তেঁতুলিয়া, মাকরখোল, রশিদপুর, চকগোপাল, বারবালা সহ প্রায় ৩০-৩৫টি গ্রাম যমুনা নদী ভাঙনে সদর উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। ১৯৮৮ সালে পর থেকে তিনি রাক্ষুসী যমুনার ভয়াবহতা দেখছেন। তার ভিটা-বাড়ি ৭ বার ভাঙনের কারণে সরিয়েছেন।

কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন জানান, তার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ প্রায় পাচ শতাধিক পরিবার যমুনার ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে। এছাড়াও বেশ কিছু ফসলি জমি এবার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।

তিনি জানান, ওমরপুর গ্রামের প্রায় পাচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জিওব্যাগ ফেলা যেত তাহলে ভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে। যমুনার পানি বাড়লে ও কমলে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়।

ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত জিওব্যাগ ফেলা প্রয়োজন।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাহিদা আক্তার ইতোমধ্যে উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পরিদর্শন করে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখেছেন। যেসব ইউনিয়ন যমুনা নদীর ভাঙন আশঙ্কায় রয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশেষ নজরদারী রয়েছে।

এবিষয় টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানান, কাকুয়া ইউনিয়নের যেসব এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে সেসব এলাকায় তারা ভাঙন প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা কাজ করতে চেষ্টা করছেন।

তিনি জানান, ভাঙন কবলিত এলাকার জন্য অনেক আগেই চাহিদা দেওয়া হয়েছে। তিনি আশা করছেন ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে বরাদ্দ অনুমোদন হয়ে আসবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে