বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

টাকা গ্রহণের সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন

পাংশা (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি
  ২৪ জুন ২০২৫, ১৯:৪১
টাকা গ্রহণের সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন
পাংশায় টাকা গ্রহণের সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়: ছবি যায়যায়দিন

রাজবাড়ী জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কার্যালয়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ঘরের জন্য আবেদনপত্র জমা দিতে আসা কৃষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দিয়েছে।

তবে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা বেশিরভাগ কৃষক এ মানববন্ধন সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। এমনকি অংশগ্রহণ করার পরেও মানববন্ধনের কারণ জানতেন না।

অনৈতিকভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় রাজবাড়ী কৃষি বিপণন বিভাগের কর্মচারীর ঘুষ নেওয়ার সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়।

এ ঘটনার প্রতিবাদ ও দৈনিক দেশ রূপান্তরের সাংবাদিকের বিচারের দাবিতে ভূক্তভোগি সাধারণ কৃষকের ব্যানারে কৃষি বিপণন কার্যালয়ের সামনে মঙ্গলবার (২৪ জুন) বেলা সোয়া ১১টার দিকে অফিস সহায়ক এনামুল হকের উপস্থিতিতে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা জানিয়েছেন, কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে তাদের সোমবার বিকেল থেকে রাত অবধি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়।

তাদের সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়। সাক্ষাতের জন্য কৃষকেরা কার্যালয়ে এলে তাদেরকে জানানো হয়, অফিস নিয়ে এক সাংবাদিক মিথ্যা নিউজ করেছে।

এতে করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ ঘরের প্রজেক্ট ফেরত চলে যেতে পারে। তাহলে জেলার সমস্ত কৃষক ঘর পাওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ প্রজেক্ট রক্ষার জন্য মানববন্ধন ও স্বারকলিপি পেশ করতে হবে।

নইলে প্রজেক্ট বাতিল হয়ে যাবে। সবাইকে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়টি অবহিত করার পর ৬০-৭০জন কৃষক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।

কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে আসা কালুখালী উপজেলার মাঝবাড়ি ইউনিয়নের কৃষক রাশেদ খান বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণ করার জন্য ঘর নিজের টাকায় করতে গেলে প্রায় আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকার মতো খরচ হবে।

এ কারণে ঘরের জন্য আবেদন করেছিলাম। গতকাল আমার কাছে অফিস থেকে ফোন করেছিল। আমার কাছে জমির ফটোকপি, জমির পর্চা ও আইডি কার্ড জমা দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার সকালে আসতে হবে।

সেটা জমা দিতে অফিসে এসেছিলাম। এসে দেখি অফিসের সামনে অনেক মানুষ। মানববন্ধন হচ্ছে। আমাদের দাঁড়াতে বলা হলো। তবে কি কারণে মানববন্ধন হচ্ছে সেটা জানি না। সবাই দাড়িয়েছে তাই আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে ডিসি অফিসে নিয়ে এলো।

কৃষক কালুখালীর মদাপুরের শামীম মোল্যা, মাজবাড়ীর কুষ্টিয়াডাঙ্গীর মোফাজ্জেল হোসেন বালিয়াকান্দির অভয়নগরের আজিম শেখ, বলেন, ঘরের প্রজেক্ট নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে। একারণে সবাইকে অফিসে আসতে হবে। দেখা করতে হবে। অফিস থেকে বলছে আপনারা আসেন দেখা করা লাগবে। সেজন্য আসছি। আমাদের দিয়ে সইটই করাইলো। এরপর দেখি অনেকে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছে। আমাকেও দাঁড়াতে বললো। সবাইকে দাঁড়াতে দেখে আমিও দাড়িঁয়েছি।

প্রায় একই কথা বলেন অন্তত আটজন কৃষক। এদের অধিকাংশের বাড়ি রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলায়।

সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক অ্যাডভোকেট খান মোহাম্মদ জহুরুল হক। তিনি বলেন, কৃষি বিপণন কার্যালয়ের অনৈতিক লেনদেনের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য এই মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এভাবে প্রকৃত ঘটনাটি ধামাচাপা বা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না।

রাজবাড়ী জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা বলেন, ঘুষ গ্রহণের ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে। কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেন বুদ্ধি দিয়ে মানববন্ধন করানো হয়েছে। এ ঘটনায় সঠিক তদন্ত পুর্বক অপরাধীর আইনের আওতায় আনা উচিত। কৃষকদের ঘর দেওয়া হবে না এ ভয় দেখিয়ে মানববন্ধন করানো টা ভয়ংকর প্রতারণা। এসকল প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেয়া গণবিজ্ঞপ্তি সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ মে, ২০২৫ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত) এর আওতায় ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে কয়েকটি জেলাসহ রাজবাড়ী জেলার কালুখালী ও বালিয়াকান্দি উপজেলার ২৫ ফুট-১৫ ফুট বিশিষ্ঠ মডেল ঘর বাঁশ, কাঠ, টিন ও আরসিসি পিলার দ্বারা তৈরি ঘর নির্মাণ করা হবে।

মডেল ঘর পেতে আগ্রহী পেঁয়াজ ও রসুন চাষীগণকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ২ কপি ছবি ও জমির পর্চা, স্বহস্তে লিখিত আবেদন জেলা বিপণন কার্যালয়ে ১৯ জুন, ২০২৫ তারিখের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়।

১৯ জুন (বৃহস্পতিবার) আবেদনপত্র জমার শেষ দিন ছিল। আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় কৃষকদের কাছ থেকে অনৈতিক ভাবে প্রতিজনের কাছ থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেয়। আবেদন বাতিলের ভয়ে কৃষকেরাও টাকা জমা দিতে বাধ্য হন।

টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সত্যতা যাচাই করতে দেশ রূপান্তরের রাজবাড়ী প্রতিনিধি একটি আবেদনের কপি নিয়ে জেলা বিপণন অফিসে গেলে আবেদন পত্রটি জমা দেওয়ার সময় তার কাছ থেকে ২০০ টাকা চান এক কর্মচারী। পরে তিনি ২০০ টাকা আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিয়ে আসেন।

এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা কার্যালয় ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করে একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের প্রত্যেকের কাছে ৩০০ টাকা দাবি করেন অফিস সহায়ক মো. এনামুল হক।

ধারণকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক কৃষক তার আবেদনপত্রটি অফিস সহায়ক এনামুল হকের কাছে জমা দিয়েছেন। এনামুল হক আবেদন পত্রটি একটি রেজিস্ট্রি খাতায় তথ্য লিপিবদ্ধ করছেন। এসময় ওই কৃষক তার পরিধান করা পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে হাতের ভেতর রেখেছেন। খাতায় লিপিবদ্ধ করা শেষ হলে হাত পেতে ওই কৃষকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন অফিস সহায়ক এনামুল হক। টাকা নেওয়ার একাধিক ভিডিও রয়েছে।

রাজবাড়ী কৃষি বিপণন কর্মকর্তা নাঈম আহম্মেদ ছুটিতে আছেন। এ কারণে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। অফিস সহায়ক এনামুল হক মানববন্ধন চলাকালে উপস্থিত ছিলেন। তবে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক আবজাল হোসেন বলেন, তাদের লাইসেন্সের জন্য টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে পেঁয়াজ ঘর প্রদানের নামে কোন টাকা নেওয়া হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে