শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় ৭০০ কোটি টাকার মরিচ উৎপাদন

ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
  ১৬ মার্চ ২০২৩, ১৩:৪৩
আপডেট  : ১৬ মার্চ ২০২৩, ১৩:৪৫
ছবি-যাযাদি

দেশে এবার মরিচের চরা বাজার হওয়ায় কৃষকদের মুখে হাঁসি ফুটেছে। বগুাড়ায় উৎপাদন হয়েছে অন্তত ৭০০ কোটি টাকার মরিচ। বিগত সময়গুলোকে হার মানিয়ে এবার সর্বোচ্চ মুনফা ঘরে তুলেছে কৃষকেরা। এর মধ্যে শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলায় মরিচের ফলন হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার।

মরিচ ও লাল মরিচের জন্য বিক্ষাত বগুড়া। প্রতিবছর উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে মরিচের অধিকাংশ চাহিদা পূরন করে থাকে বগুড়ার মরিচ। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭,২৫০ হেক্টর, অর্জিত হয়েছে ৫,৬৫০ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমিতে গরে ১৩ মেট্রিকটন ধরে অর্জিত ফলন ৭৩,৪৫০ মেট্রিক টন। কাঁচা মরিচের আওতায় জমির পরিমান ২,৯৪০ হেক্টর ও উৎপাদন ৩৯,৬৯০ মেট্রিক টন। শুকনা মরিচের আওতায় জমির পরিমান ৩,৫৮৯ হেক্টর ও উৎপাদন ১০,২২৮ মেট্রিক টন। কাঁচা মরিচের মোট বিক্রয় মূল্য প্রায় ৪৭৭ কোটি টাকা ও শুকনো মরিচের বিক্রয় মূল্য প্রায় ৪১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৬৮৭ কোটি টাকার মরিচ ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে এই জেলায়।

গত বছরের চেয়ে মরিচের আবাদ ও উৎপাদন কম হলেও বাজার মূল্য বেশি থাকায় রপ্তানিতে আয় বেরেছে কৃষকদের। এতে করে মরিচের প্রতি পূনরায় আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। আগামি বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জিত বেশি হবে বলে মনে করছেন কৃষি বিভাগ।

জেলায় উল্লেখযোগ্যহারে মরিচ উৎপাদন হয়ে থাকে সারিয়াকান্দি ও সোনাতলার যমুনা চরে। এই দুই উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে বেশি আবাদ হয়। কারন প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুরে সারিয়াকান্দির যমুনা চর। এই চরে এবার মরিচের আবাদ হয়েছে ৩,১৭০ হেক্টর জমিতে। আর সোনাতলায় আবাদ হয়েছে ১০১০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া অন্যান্য উপজেলাগুলোর মধ্যে সদরে ৭০ হেক্টর, শাহাজানপুরে ২১৫, শেরপুরে ১৫০, ধুনটে ৩০০, শিবগঞ্জে ২৫০, কাহালুতে ৫০, দুপচাঁচিয়ায় ৪৫, আদমদিঘীতে ৩৫ ও নন্দীগ্রামে চাষ হয়েছে ২৫ হেক্টর জমিতে। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী শুধু সারিয়াকান্দির যমুনা চরে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

কৃষি বিভাগ বলছেন মরিচ একটি অত্যান্ত অর্থকরি ফসল এই ফসল থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে যমুনা চরের বানভাষী মানুষগুলো দুর্যোগকালীন সময়ে মোকাবেলা করে থাকে। মরিচ চাষের সময়টুকুতে তেমন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকেনা তাই একটু যত্নের মাধ্যমে ভালো ফসল ফলাতে পারলেই বেশ ভালো মুনফা ঘরে তুলতে পারবেন তার।

এখন জমি থেকে কাচা মরিচ উঠানো প্রায় শেষ, লাল মরিচ আছে অল্প কিছু জমিতে। চলছে লাল মরিচ সংগ্রহ ও বাজার জাতকরনের প্রক্রিয়া।

চরাঞ্চলে গেলেই দেখা মিলবে মরিচ গাছে সবুজ পাতা নেই, আছে শুরু লাল মরিচ, অর্থাৎ লাল মরিচের কারনে জমিটিই লাল হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও সাদা বালির উপর মরিচ শুকাতে দেয়ায় দুর থেকে দেখে মনে হবে লাল গালিচায় ঢেকে দেয়া হয়েছে চরের এই সাদা বালি। শুকাতে দেয়া এসব মরিচ হিমাগার অথবা বাজারের উপযোগী করে তুলতে কাজ করছে নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা। তারা কোয়ালিটি ভেদে কয়েকটি অংশে এসব মরিচ বাছাই করছে। শুকানো শেষে এসব মরিচ বাজারে অথবা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রয়, গোডাউনে সংগ্রহ আবার কিছু কিছু ব্যবসায়ীরা হিমাগারেও রেখে দেয়। তবে এবার বাজারে লাল মরিচের চাহিদা ও দাম প্রায় দ্বিগুন হওয়ায় জমি অথবা আরৎ থেকেই বেশি বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি লাল মরিচের দাম ১৪০-১৭০ টাকা পর্যন্ত। বিগত দিনে অর্থাৎ গত বছরেও লাল মরিচ বিক্রয় হয়েছে ৫০-৭০ টাকা পর্যন্ত। জমি থেকে এসব লার মরিচ সংগ্রহ করে শুকানো হলে ৪-৫ কেজি মরিচ শুকিয়ে ১ কেজি হয়। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি শুকনো মরিচ ৪০০ থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হচ্ছে।

সরেজমিনে সোনাতলা উপজেলার তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চুকাইনগর, চর সুজাইতপুর, সুজোলের পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে কথা হয়, আবুল কালাম, হামেদ আলী, আজিজুল ইসলাম,আলাউদ্দিন, জামিরুল ইসলাম, জিয়ারুল, উজ্জল, শাহ্ আলম, আনিছুর রহমানসহ বিভিন্ন কৃষক। এছাড়া সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি ও কুতুবপুর ইউনিয়নের জব্বার বেপারি আশরাফ আকন্দ, কালাম মিয়া, কিনে শেখ, মাজেদুর রহমান, আশাদুল ইসলাম, রবি আহমেদসহ অন্যান্য কৃষকদের সাথে তারা বলেন বিগত দীনের চেয়ে এবার মরিচের ফলন কিছুটা কম হলেও বাজার ভালো থাকায় অনেক লাভোবান হয়েছি আমরা। প্রতিবিঘা জমির মরিচ দের থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিক্রয় হয়েছে। এতে করে আগামিতে মরিচের প্রতি কৃষকরা আরো বেশি আগ্রহশীল হয়েছে।

এসব কৃষক আরো বলেন গত বছর চরাঞ্চলে হাইব্রিড জাতের মরিচের বেশি আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে ছনিক ও বিজলী প্লাস উল্লেখযোগ্য তবে চরা মূল্যে এসব প্যাকেট বীজ কিনে কৃষকরা প্রতারিত হয়েছে। যার কারনে এবার দেশি জাতের মরিচের চাষ বেশি হয়েছে। আগামিতে দেশি জাতের মরিচ আরো বেশি চাষ করা হবে। কারন নিজের জমি থেকে ভালো মানের মরিচ সংগ্রহ করে শুকিয়ে ঘরে বীজ হিসেবে রাখা যায়। তাই নিজের বীজ বপন করে ভালো ফলন পাওয়ার শতবাগ আশা করা যায়। ফলন একটু কম হলেও বীজ ব্যাবসায়ীদের কাছে প্রতারিত হতে হবেনা। কারন গত বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও নানা ধরনের কিটনাশক ও বিভিন্ন ধরনের হরমোন ব্যবহার করেও হাজার-হাজার বিঘা জমির মরিচের গাছ টেকানো সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ বেশি লাভের আশায় সমূলে নষ্টের চেয়ে ঘরের বীজে কম ফলন পাওয়াও ভালো।

মরিচ চাষ ও মরিচের নানা বিষয়ে কথা বললে গিয়ে বগুড়া কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মোঃ মতলুবর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন মরিচ একটি সংবেদনশীল ফসল। এই ফসল থেকে ভালো কিছু পেতে হলে কৃষক ভাইদেরকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ও অনেক যত্নবান হতে হয়। কারন একটু খানি ভূল সিদ্ধান্ত ও অবহেলার কারনে বড় ধরনের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে। যেমন প্রথম অবস্থাতেই জমিকে বীজ বপনের উপযোগী করে তুলতে প্রয়োজন মতো সার ও কিটনাশক ছিটাতে হয়। এরপর নির্ভরযোগ্য জায়গা থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। কারন মরিচ চাষে বীজটাই হলো ফসলের মূল চাবিকাটি। বীজ বপনের পর থেকেই প্রতিদিন জমিতেই সময় দিতে হয় কৃষকদের। পয়োজন মতো সার, পানি, কিটনাশক ও বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও হরমোন ছিটিয়ে মরিচের গাছকে শক্তিশালি করে তুলতে হয়। এর পর ফুল আসার সময় থেকে মরিচ সংগ্রহ পর্যন্ত এই ফসলের প্রতি লেগেই থাকতে হয়। তবেই একজন কৃষক মরিচ থেকে ভালো কিছু পাবেন। বগুড়া কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকদের পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে থাকে। আগামিতে কৃষিকে আরো এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকারকে সর্বাত্তোক সহযোগিতা করে যাবে।

উল্লেখ্য চরাঞ্চলের মানুষের দুর্যোগকালীন সময়ে বেঁচে থাকার একমাত্র ফসলের নাম মরিচ। অর্থাৎ জীবন যুদ্ধে তারা যে অর্থ ব্যাবহার করেন সেটি আসে মরিচ থেকে। নির্ভরশিলতার এই ফসলের প্রতি তাদের রয়েছে মায়া, মমতা, ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধাসহ অজস্র সম্মান। তাই তাদের বিশেষ আকুতি কৃষি বিভাগ যেনো তাদের পাশে থাকে। অর্থ দিয়ে না হলেও পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে ভালো ফসল ফলানোয় সহযোগিতা পেলেই তারা আগামিতে ভালো কিছু করতে পারবে। এসব কৃষকদের দাবি বিভিন্ন সময় মরিচসহ নানা ধরনের ফসলের বীজ ও সারসহ বিভিন্ন প্রনোদনাগুলো সঠিক সময়ে বিতরণ করার জন্য। কারন বীগত দিনে বাজার থেকে বীজ কিনে বপন করে সেই জমি থেকে মরিচ উঠানোর সময় সরাকারি বীজ বিতরণ করা হয়। অর্থাৎ এসব বীজ নিয়ে উপকারতো দুরের কথা, অপকারের অংশটাই বেশি। কারন এসব বীজ নিতে চরাঞ্চল থেকে ৫-১০ কিলোমিটার পায়ে হেটে ও নৌকা যোগে উপজেলা শহরে পৌছে সারাদিন চাতক পাখির মতো চেয়ে থেকে সন্ধ্যা নাগাদ রাজনৈতিক নেতা/নেত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের হাত থেকে বীজ সংগ্রহ করে রাতের আধাঁরে বাড়ি ফিরতে হয়। এই বীজ আনতে গিয়ে একটি দিন পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়, আর বীজ নিয়েতো কোন কাজেই লাগেনা।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে