‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে, চুকিয়ে দেব বেচাকেনা, মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনাদেনা, বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে- তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে,।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তার সৃষ্টিকর্ম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাঙালির চিন্তা-চেতনায়, উৎসব-আনন্দে, সংস্কৃতি ও নিত্যদিনের জীবন-যাপনেও তিনি হয়ে উঠেছেন অবিচ্ছেদ্য।
আজ ২২শে শ্রাবণ। বাংলা সাহিত্যের মহীরূহ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ দিবস। বহু প্রতিভার অধিকারী এই কবি তার আলোয় উদ্ভাসিত করে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন বিশ্ব দরবারে। পেয়েছেন বিশ্বকবির সম্মান। তিনি বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক কিছুরই প্রথম রূপকার তিনি। তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। বাংলা গদ্যের আধুনিকায়নের পথিকৃৎ ও ছোটগল্পের জনকও তিনি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা ছাড়াও বিচিত্র গানের বাণী, সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, এমনকি চিত্রকলায়ও তিনি চির নবীন-চির অমর। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে শৈশবেই। মাত্র ৮ বছর বয়সে তার লেখালেখির হাতেখড়ি। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকেই বিরামহীন লিখেছেন তিনি। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেছেন। লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের পাঠ্যসূচিতে তার লেখা সংযোজিত হয়েছে।
১৮৭৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। এ সময় থেকেই কবির বিভিন্ন ঘরানার লেখা দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রধান উপজীব্য ছিল জীবনানুভূতি যেখানে বাঙালির জাতিসত্তা, আশা-আকাক্সক্ষা-নিরাশার আবেদনগুলো স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এটি এমন প্রবলভাবে এসেছে যে তিনিই হয়ে উঠেছেন বাঙালির জাতিসত্তা ও বোধের এক অপার আধার।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে এবং উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদারবাড়িতে বসে অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। কবি জমিদারি করলেও তার প্রজাহিতৈষী মনোভাব সর্বজন বিদিত। বাংলায় আলু, ভুট্টা ইত্যাদি চাষের সূচনা ঘটে তারই উদ্যোগে। দরিদ্র কৃষককে ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যে নোবেল পুরস্কারের অর্থে কৃষি ব্যাংকের কাজ শুরু করেন তিনি। বঙ্গভঙ্গ রদ করার দাবিতে তিনি হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে রাখিবন্ধন কর্মসূচিতে রাজপথে নেমে আসেন। মানুষের মুক্তির দর্শনই ছিল রবিঠাকুরের দর্শন। কবি বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেই দর্শনই অন্বেষণ করেছেন তিনি।
১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। কবি ২ হাজার গান রচনা করেছেন। অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। তার সমগ্র গান ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে রয়েছে। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতটিও কবির লেখা। জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩, ছোটগল্পের বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগুলো ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মৃত্যুর পর ৩৬ খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ হয়েছে। এ ছাড়া ১৯ খণ্ডের রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র।’ ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মের সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কবির প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে বিচরণ করেননি রবীন্দ্রনাথ।
বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নানা কর্মসূচি নিয়েছে। আজ বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করবে বিশ্বকবিকে। বিভিন্ন পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
যাযাদি/ এস