শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জেনারেটরের বিশ্রাম লাগে, লোডশেডিংয়ে বেশি ক্ষতি ব্যবসায়ীদের 

সাখাওয়াত হোসেন
  ৩১ মে ২০২৩, ১১:৪৫

ডলার সংকটে বিল বকেয়া থাকায় পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পথে। গত ছয় দিন ধরে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে যে কয়লা মজুত আছে তা দিয়ে ২ জুন পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। ফলে আগামী ৩ জুন থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু পায়রা নয়, জ্বালানি সংকটের কারণে এই মুহূর্তে ৫৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। এছাড়া কারিগরি সমস্যার কারণে ৩১টি আর রক্ষণাবেক্ষণে বন্ধ আছে ১৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফলে ফের লোডশেডিং বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে শিল্প ও কৃষিতে উৎপাদন খরচ হু হু করে বাড়বে বলে মনে করেন এই দুই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

শিল্প মালিকরা জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে বেশকিছু দিন ধরে বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি মেটাতে অনেক কারখানা নিজস্ব ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এতে উৎপাদন ব্যয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যুৎ সংকট আরও তীব্র হলে উৎপাদনের বাড়তি খরচ ৩০ শতাংশে গিয়ে ঠেকবে।

এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পাম্পসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি পরিচালনা করায় খাদ্য শস্যসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদন খরচ ধাপে ধাপে বাড়তে শুরু করেছে। যা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

শিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগে থেকেই আকাশচুম্বী ফ্রেইট চার্জ, সরবরাহ চেইনের বিঘ্ন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইনপুট খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে ছিলেন তারা। এর মধ্যে চলমান বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকট তাদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে। যেসব কারখানায় ফার্নেস অয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেখানে খরচ বেশি হলেও উৎপাদন অব্যাহত রাখা যাচ্ছে। যেখানে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই সেখানে প্রডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরের শিল্পগুলোতে দিনে তিন-চারবার পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। এতে উৎপাদন কার্যক্রম ভীষণ বিঘ্নিত হচ্ছে। কোনো কোনো শিল্প কারখানায় এখনই উৎপাদন ১০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। লোডশেডিং বাড়লে তা ১৫ থেকে ২০ শতাংশে গিয়ে ঠেকার শঙ্কা রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন খরচ বাড়বে বলে মনে করেন তারা।

সিমেন্ট, ইস্পাত, ভোজ্যতেল, গ্লাস ও কাগজ কারখানার মালিকরা জানান, এসব ভারী শিল্পে মেশিন চালু করতেই অনেক সময় লাগে। এসব শিল্পে একবার কোনো উৎপাদন লাইন বন্ধ হলে তা আবার চালু করতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট লেগে যায়। এতে করে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে শুধু যে সময়ই নষ্ট হচ্ছে তা নয়, উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহে আগামীতে আরও বড় ঘাটতি হলে পোশাক খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। তাদের ভাষ্য, অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে উৎপাদন কেন্দ্রগুলো বিপাকে পড়ছে। এতে সময়মতো শিপমেন্টও কঠিন হয়ে যাবে। শিপমেন্টের ডেডলাইন বাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে কিছু পণ্য এয়ার ফ্রেইটের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। চলমান বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলায় তারা সীমিত পরিসরে ডিজেলচালিত জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে তাদের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

বিদ্যুৎ সংকট আগামীতে আরও তীব্র হলে ইস্পাত ও সিরামিক কারখানাগুলো বড় ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট শুরু হলে উৎপাদন খরচ ২০ শতাংশের বেশি বাড়বে।

এদিকে লোডশেডিংয়ের খড়গ নেমে আসতে পারে চা শিল্পে। ব্যবসায়ীরা জানান, লোডশেডিংয়ের কারণে চা পাতা মেশিনে দিয়ে চা উৎপাদনে কয়েক ধাপ পেরোনোর আগেই মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার লোডশেডিংয়ের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন চা বাগানের কারখানাগুলো সচল রাখতে জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। আগামীতে লোডশেডিং আরও দীর্ঘ হলে, বায়ার থেকে শুরু করে চা বাগান মালিক ও ব্যবসায়ী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গাজীপুরের টঙ্গীতে দিনে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিংয়ের কারণে কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শিল্প মালিকরা। এই অবস্থার দ্রুত প্রতিকার চেয়েছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, লোডশেডিংয়ে জেনারেটর ব্যবহার করার কারণে মাঝারি মানের কারখানায় প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ২০০ লিটার ডিজেল খরচ হচ্ছে। এতে যে টাকা গচ্চা যাচ্ছে, তা উৎপাদন খরচে গিয়ে যোগ হচ্ছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, লোডশেডিংয়ে জেনারেটর চালানো হলেও তা একটানা বেশিক্ষণ চালিয়ে রাখা সম্ভব না। এক ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে এক ঘণ্টার বেশি বিশ্রাম দিতে হয়। লোডশেডিং হয় তিন থেকে চার ঘণ্টা। একটানা তিন বা চার ঘণ্টা লোডশেডিং হলে এক ঘণ্টা জেনারেটর চালিয়ে বন্ধ রাখায় উৎপাদন বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সম্প্রতি জ্বালানি সংকটে দেশে শুরু হওয়া লোডশেডিং সামাল দিতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। রমজান মাসজুড়ে লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে এই কেন্দ্রের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এখন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে সংকট তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে।

পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩৩টি। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫৭টি, তেলভিত্তিক ৬৭টি, কয়লাভিত্তিক তিনটি, নবায়নযোগ্য ছয়টি। এগুলোর মাধ্যমে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায় মোট ৮৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এছাড়া কারিগরি ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য কারণে ৩৪১৪ মেগাওয়াট উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় আগামী মাস থেকে ফের লোডশেডিং বাড়তে পারে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে