শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা!

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৬
বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা!

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে ৪৬৩ কোটি ৬০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল। গেল অর্থবছরে তা কমে ৪৫০ কোটি ডলারে নেমেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়।

আলোচিত অর্থবছর নিট বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। এ সূচকটি আগের বছরের চেয়ে ১১.৮২ শতাংশ কমে ১৬১ কোটি ডলার হয়েছে। আগের অর্থবছরে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৮২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

একই সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

পুঁজিবাজারের নাজুক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এর কিছু পলিসিগত ত্রুটির কারণে দিনে দিনে ফরেন ট্রানজেকশন (বিদেশি লেনদেন) ও বিনিয়োগ কমছে বলে জানিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তবে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও ফরেন ট্রানজেকশন কমতে শুরু করেছে।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা জানান, পুঁজিবাজারের অধিকাংশ কোম্পানি ডিভিডেন্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। অনেক কোম্পানি আছে, যেগুলো প্রফিট হওয়ার পরেও ডিভিডেন্ড দেয় না অথবা বিনিয়োগকারীদের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ডিভিডেন্ড দেয় না। এসব কারণে প্রতিনিয়ত পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমতে শুরু করেছে। কমছে ফরেন ট্রানজেকশন। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি বিনিয়োগ কমলে, বিদেশি লেনদেনও আপনা-আপনি কমতে শুরু করে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, পুঁজিবাজারে বিদেশি লেনদেন বাড়াতে হলে দেশের পুঁজিবাজারকে ঠিক করতে হবে। ভালো মানের কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। কোম্পানিগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিএসইসিসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ডিএসইতে মোট ফরেন ট্রানজেকশন হয়েছে ১০ হাজার ৩৮৭ কোটি ৬৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৫ টাকা। আর ২০২২ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ১৭৯ কোটি ৯২ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৩ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে ফরেন ট্রানজেকশন কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২০৭ কোটি ৭৩ লাখ ২৮ হাজার ৩২ টাকা। অর্থাৎ ৫৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ বিদেশি লেনদেন কমেছে। আর ডিএসই’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুন মাসে বিদেশি লেনদেন এসে দাঁড়িয়েছে ৯৭৯ কোটি ২০ লাখ ৬২ হাজার ২৪৬ টাকা; যা আনুপাতিক হারে গত কয়েক বছরের তুলনায় আরও কমেছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিএসইতে বিদেশি লেনদেন হয়েছে ৪৭ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর সবশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের মে মাসে বিদেশি লেনদেন কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

বিদেশি যেসব ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণসীমা দিত, সময়মতো পাওনা না পাওয়ায় তাদের কেউ কেউ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় চলে গেছে আবুধাবি ইসলামিক ব্যাংক। এছাড়া জাপানের এসএসপিসি ব্যাংক, দুবাইয়ের মাশরেক, ভারতের এক্সিমসহ বিদেশি কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে।

এদিকে বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি কম হলেও দেশটি আশানুরূপভাবে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে না। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) ত্রৈমাসিক অর্থনৈতিক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি, দুর্বল সঞ্চালন অবকাঠামো, শিল্পের জন্য জমির অভাব, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও নিয়মকানুন সবক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছে না।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, গেল বছরের শেষ প্রান্তিকে দেশের ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। যা এখনো চলমান রয়েছে। এছাড়া বিদেশি পাওনা পরিশোধে অক্ষমতা, বিভিন্ন ব্যাংকের ডলার সংকটের খবর- এসব কিছু বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বিদেশি বিনিয়োগ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা সাতটি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দুর্নীতি। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাব ও ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ জোগানে সক্ষমতার অভাব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। এর বাইরেও বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের অভাবকে দায়ী করে থাকেন।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আগে দেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। দেশি বিনিয়োগকারীদের দেখে বিদেশিরা এগিয়ে আসবেন। তাদের মনে আস্থার সঞ্চার করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। দেশের ভালো ইমেজ গড়ে তোলা জরুরি। তা হলেই শুধু বিনিয়োগ আসবে। শুধু এক-দু’টি পদক্ষেপ নিলে বিনিয়োগ আসবে না। বিদেশি বিনিয়োগ খাত পর্যবেক্ষণকারীরা জানান, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা প্রথমেই বড় বাধায় পড়েন যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সাধারণত দেশে বিদেশি বড় বিনিয়োগ আসে দেশি উদ্যোক্তার হাত ধরে। কিন্তু দেশের বিনিয়োগকারীরা যৌথ উদ্যোগে কারখানা করতে আগ্রহী নন। তারা একক মালিকানায় শিল্প স্থাপনেই আগ্রহী বেশি। ফলে বিনিয়োগ সম্মেলন, আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যে সম্পর্ক হয় তাতে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।

আর উদ্যোক্তাদের মতে, ব্যবসায় নানা জটিলতা রয়েছে। কারখানা চালাতে স্থানীয় পর্যায়ে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। কেন্দ্রীয় অফিস থেকেও নানা ঘাটে চাঁদার চাহিদা মেটাতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া বর্তমানে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট প্রকট। চড়া দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে এগুলোর সরবরাহ মিলছে না। অবকাঠামোগত সমস্যা তো আছেই। এগুলোর মধ্যে বিদেশিদের ডেকে এনে বিপদে ফেলতে হবে। এ কারণে অনেকেই বিদেশিদের দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছেন না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানর সাবেক মহাপরিচালক ডক্টর মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে ও দারিদ্র্য দূর করতে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য রক্ষায়ও তা জরুরি। এজন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করতে হবে। বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের যে সংকট এটি চলতে থাকলে বিনিয়োগ আসবে না। এগুলোর সমাধান করতে হবে দ্রুত।

এদিকে জাপানিজ এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) সাম্প্রতিক জরিপে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ওই সমীক্ষায় জাপানি সংস্থাগুলো বলেছে, অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বিনিময় হারের অস্থিরতা, স্থানীয় কাঁচামাল সংগ্রহে অসুবিধা, বিদ্যুতের ঘাটতি, বিদ্যুৎ কাটার ফ্রিকোয়েন্সি এবং জটিল শুল্ক পদ্ধতি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য বাধা সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ হলো শ্রম আইনের শিথিল প্রয়োগ, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সীমিত অর্থায়নের সুযোগ। তবে কিছু ক্ষেত্রে এসব সীমাবদ্ধতার উন্নতি হচ্ছে। এর মধ্যে আছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতিতে সরকারের প্রচেষ্টা দেখা গেছে, কিন্তু বাস্তবায়নে ঘাটতি আছে। এছাড়া নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জও এ দেশে কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের সুযোগ বিনষ্ট করছে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য নয়টি খাতকে বিপুল সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষি যন্ত্রপাতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রকৌশল সেবা, বস্ত্র ও পোশাক প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি ও সেবা, শিক্ষা, ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে