শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

গ্রুপিংয়ে জর্জরিত নাটোর বিএনপি, বিপাকে নেতাকর্মীরা!

স্টাফ রিপোর্টার, নাটোর
  ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯:৫৬
গ্রুপিংয়ে জর্জরিত নাটোর বিএনপি, বিপাকে নেতাকর্মীরা!
যায়যায়দিন

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জেলাজুড়ে বিএনপির কমিটি গঠণকে কেন্দ্র করে নাটোরে বিএনপির দুটি গ্রুপ প্রকাশ্যে দৃশ্যমান। এতে নেতাকর্মীরাও দ্বিধা বিভক্ত হয়েছেন।

অপরদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাদের বাধা নেই, সেই সব রাজনৈতিক দলে কোন গ্রুপিং না থাকায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন তারা।

তথ্যমতে,দীর্ঘদিন থেকেই নাটোর জেলা বিএনপির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।

বিগত আওয়ামী শাসনামলেও বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বিএনপি নাটোর (সদর-নলডাঙ্গা) আসনে এমপি মনোনয়ন দিয়েছেন দুলু অথবা দুলু জেলে থাকলেও তার স্ত্রী জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ছাবিনা ইয়াসমিন ছবি-কে।

এদিকে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু কেন্দ্রীয় বিএনপির পদ পাওয়ায় জেলা বিএনপির সভাপতিসহ ফুল কমিটি তার নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তবে দীর্ঘ সময় নাটোর জেলা বিএনপি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর আওতাধিন থাকা অবস্থায় হঠাৎ দুলুর বিপক্ষে মাঠে উপস্থিত হন বিশিষ্ট শিল্পপতি আবুল কাশেম।

হঠাৎ নাটোর রাজনীতিতে আবির্ভুত হয়ে লোকসমাগম,মতবিনিময়, নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে তৃপ্তিসহ আহার করানোর মতো উদ্যোগ নেন তিনি। ঘোষণা দেন সদর-নলডাঙ্গা আসনে বিএনপি মনোনীত এমপি হিসাবে ভোটে দাঁড়ানোর সম্ভাবনার কথা। এরই কিছু দিন পর,বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ী বহরে!যাওয়ার সময় হামলার শিকার হন তিনি।

ওই ঘটনার পর থেকে কার্যত নাটোর বিএনপি রাজনীতীতে অনুপস্থিত থাকলেও ঢাকার গাজীপুর বিএনপি এবং আমরা বিএনপি পরিবার সংগঠনের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি। এতে কেন্দ্রীয় বিএনপি ছাড়াও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরী হয় তার।

গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী শাসনামলের অবসানের পর গঠিত নাটোর জেলা বিএনপি কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয় তার নাম। এছাড়া ওই কমিটিতে লালপুর,বড়াইগ্রাম,সিংড়া,গুরুদাসপুর উপজেলা থেকেও সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ওই কমিটি থেকে বাদ পরেন দুলুর ঘনিষ্ঠখ্যাত ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহীনসহ ঘনিষ্ঠ কিছু নেতা। শুধু তাই নয়,ওই জেলা কমিটিতে রাখা হয়নি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নাম।

এতে ক্ষোভ ছড়িয়ে পরলেও কয়েকদিন পর তা থেমে যায়।

অপরদিকে জেলা কমিটিতে নাম চলে আসায় রাজনীতিতে সক্রিয় হন শিল্পপতি আবুল কাশেম। বিভিন্ন মিটিংয়ে তিনি আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নিজকে ইংগিত দেন। অপরদিকে রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুও পাল্টা বিভিন্ন সভা সমাবেশ করে আসন্ন নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হিসাবে নিজের নাম ইংগিত করেন। এতে বেকায়দায় পড়েন জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ।

এক সময়ের বিএনপি ঘাঁটি খ্যাত নাটোর ২ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৪ হাজার ২৯ জন।

সচেতন মহলের দাবী, এই আসনে বিএনপির একক প্রার্থী হলে নি:সন্দেহে জিতবে। আর যদি বিএনপির মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব বজায় থাকে তবে জামায়াত বা অন্য কোন প্রার্থী এমপি নির্বাচিত হতে পারে।

জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপির ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের দাবী,এক সময় নাটোর সদর আসনে দুলুর কোন বিকল্প ছিল না। শুধু তাই নয়,পুরো জেলায় বিএনপি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন দুলু। তবে কালের পরীক্রমায় জেলার সকল উপজেলায় দুলুর সেই নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই দূর্বল হয়ে যাওয়ায় গোপনে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিপক্ষ।

ত্যাগী নেতাদের এক পক্ষের দাবী,জেলা বিএনপিতে দুলু পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের একচ্ছত্র নেতৃত্বই চলেছে দীর্ঘদিন। আর একারণে দীর্ঘদিন থেকে যোগ্য হওয়া স্বত্বেও জেলার বিভিন্ন উপজেলার ত্যাগী নেতারা মূল্যায়ন হননি। এতে নাটোর জেলায় বিএনপিতে গণতন্ত্রের চর্চা উপেক্ষিত হয়েছে। বিএনপির বৃহত্তর সার্থে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হলে বিকল্প নেতৃত্ব মাঠে আসা প্রয়োজন যার নমুনা হিসাবে সদর আসনে আবুল কাশেমের আবির্ভাব।

অপর পক্ষের দাবী,নাটোর জেলায় দুলুর নেতৃত্বে যে বিএনপি তা হিমালয়ের পাহাড়ের মতই দৃঢ় আর শক্তিশালী। নাটোর জেলা বিএনপি মানেই দুলু। দুলুর নেতৃত্ব ছাড়া নাটোর জেলা বিএনপি শক্তিশালী হবে না।

তাদের আরো দাবী,নাটোর সদর-নলডাঙ্গা উপজেলার রামশার কাজিপুরে ১৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট মামলায় ৭ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় গত দুটি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি দুলু। ওই দুই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তার সহধর্মিণী তৎকালীন জেলা বিএনপির সহসভাপতি ছাবিনা ইয়াসমিন ছবি।

চলতি বছরের শুরুতে আদালতে আপিলের রায়ে দুলুসহ ৬৮ জন দণ্ডপ্রাপ্তকে খালাস দেওয়ায় এখন আর তার প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই। ফলে নাটোর সদর আসনে এবারও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশাী অ্যাডভোকেট এম রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু।

জেলা বিএনপির আহ্বায়ক রহিম নেওয়াজ বলেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে মাঠে দিনরাত কাজ করছেন রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তার সাথে মাঠে রয়েছেন জেলা বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ সব অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই সব সমাবেশে দুলুকে সমর্থন জানাতে মানুষের গণজোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।

অপরদিকে আবুল কাশেম অনুসারী বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার সাথে আবুল কাশেমের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কেন্দ্রীয় বিএনপি ও নাটোর জেলা বিএনপির একটি অংশও গোপনে কাশেমকে সমর্থন করেছেন। অপরদিকে দুলুর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় বিএনপিতে রয়েছে নানা অভিযোগ। এগুলোর বিবেচনায় আগামী নির্বাচনে আবুল কাশেমের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়।

আবুল কাশেমের ঘনিষ্ঠজন খ্যাত,এক বিএনপি নেতা জানান,,কেন্দ্রীয় বিএনপি,তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার সম্মতিতে যাকেই মনোনয়ন দিক না কেন,বিএনপি নেতাকর্মীরা তাকেই ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ী করবেন। এক্ষেত্রে প্রার্থী কোন বিষয় নয় । তিনি দাবী করেন,দুলুকে মনোনয়ন দিলে নাটোরে আবারও বিএনপিতে দুলুর পরিবার তন্ত্র গড়ে উঠবে। এটি কেন্দ্রীয় বিএনপিসহ জেলা,উপজেলা বিএনপির ত্যাগী একাংশ চায় না । ফলে আগামী নির্বাচনে আবুল কাশেমের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

তিনি আরো দাবী করেন,শিল্পপতি আবুল কাশেম শহীদ জিয়ার আদর্শের সৈনিক। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার অনুসারী,একজন প্রকৃত জনদরদী। তিনি প্রকাশ্য ও গোপনে জেলার সাধারণ মানুষ,মসজিদ,মাদ্রাসা ও নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠণে আর্থিক সহযোগীতা করে আসছেন দীর্ঘ দিন থেকে। এলাকার কোন মানুষ তার কাছে সহযোগীতা চেয়ে কখনওই খালি হাতে ফেরেন না। বিশেষ করে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠণের যে কোন নেতা-কর্মীর সমস্যায় সব সময়ই তিনি পাশে থাকেন।

শুধু তাই নয়,শুধুমাত্র বিএনপি করার কারণে হামজা গ্রুপের মালিক এই আবুল কাশেমকে নানা ভাবে বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিভিন্ন ভাবে বাধা বিঘ্ন ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুক্ষিণ করেছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনামলে তাকে ডিজিএফ আই তিনদিন গুম করে রাখে। ঢাকার মতিঝিলে কাউন্সিলর শামিম তার কাছ থেকে তিন কেটি টাকা নিয়ে নেয়। এছাড়া গত ১৬ বছরে বিএনপি করার কারণে তার প্রায় দেড় শত কোটি টাকার ক্ষতি হলেও বিএনপি ছাড়েননি আবুল কাশেম। এমন ত্যাগী ও জনদরদী নেতারই আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া শোভা পায় এমন দাবী তার।

এদিকে নাটোর জেলা বিএনপির একটি অংশ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন,নাটোর সদর-নলডাঙ্গা আসনে

নাটোর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ও বাগতিপাড়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ইউনুস আলীকে এমপি প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুতে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ মাঠে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে জনসমাবেশ করে তাকে প্রাথী হিসাবে বিজয়ী করতে ভোটও চাওয়া হয়েছে।

এরআগে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর কাছে খুব সামান্য ভোটে পরাজিত হয়ে নাটোরে সাড়া ফেলেছিলেন ইউনুস আলী।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবী,জামায়াতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামী দল ও এনসিপি জেটবদ্ধভাবে একক প্রার্থী ঘোষণা করলে তাদের ভেটসংখ্যা খুব কম হবে না। এমন অবস্থায় বিএনপি ঐক্যবদ্ধ প্রার্থী দিতে না পারলে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতায় পড়তে পারে। এমন অবস্থায় দ্রুত সময়ের মধ্যে নাটোর সদর আসনে বিএনপির একক প্রার্থী ঘোষণা ও দলীয় বিভাজন বন্ধে কেন্দ্রীয় বিএনপির পদক্ষেপ জরুরী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে