ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার করা গোড্ডা চুক্তি সরকারের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দরে কেনা আদানির বিদ্যুৎ আগামীতে আর এক মেগাওয়াট না নিলেও এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিবছর ৪শ’ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্যমান প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।
আর এ চুক্তির মেয়াদ যেহেতু ২০৪৫ সাল পর্যন্ত রয়েছে, সে হিসাবে চলতি বছর বাদ দিয়েও আগামী ২১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ৮ হাজার ৪শ’ ডলার। যা বাংলাদেশি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। তবে চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ যেহেতু মার্কিন ডলারে পরিশোধ করার কথা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ডলার দাম বাড়লে এ টাকার অঙ্ক সে অনুযায়ী আরও বাড়বে।
তবে খুব শিগগিরই এই বৈষম্যমূলক গোড্ডা চুক্তি বাতিল করতে পারে বাংলাদেশ। এরইমধ্যে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে শুল্ক কর বিষয়ে অনিয়ম রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নামছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (সিআইআইডি)। শুল্ক সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কিনা, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কিনা, এমন আরও প্রশ্ন সামনে রেখে তদন্ত করছে সিআইআইডি। গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া তদন্ত কমিটির অনুসন্ধান ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে কমিটিকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছেন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা আদানির সঙ্গে এই অস্বাভাবিক লোকসানি চুক্তি কেন করেছিলেন তা তাদের বোধগম্য নয়। তাদের ভাষ্য, এটি কর্পোরেট জালিয়াতির সর্বোচ্চ উদাহরণ। এ চুক্তি থেকে বিশেষ কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কারণেই হয়তো তা গোপন করা হয়েছিল।
তবে সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট শেখ হাসিনা এবং আদানির সেই গোপন চুক্তির ১৬৩ পৃষ্ঠার অতি গোপন নথি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ওয়াশিংটন পোস্ট তিনজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ওই চুক্তি পর্যালোচনা করিয়ে এটি প্রতিবেদন আকারে প্রকাশের পর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শেখ হাসিনার সঙ্গে আদানির করা গোড্ডা চুক্তির কতগুলো শর্ত সবার সামনে আসলে দেশে এই বিষয়টি নিয়ে মারাত্মক অসন্তোষ সৃষ্টি হতো। হয়তো এ আশঙ্কা থেকেই চুক্তির পুরো বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। এ সময় শুধু জানানো হয়, ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় ১৬ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সেখান থেকে ২৫ বছর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এর বাইরে চুক্তির আর কোনো শর্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি এই চুক্তি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষ কখনোই কোনো খোলামেলা আলোচনা করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আদানির সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি একটি সার্বভৌম সরকারের সঙ্গে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। এর সঙ্গে ভারত সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
অথচ ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মোদি সরকারের সঙ্গে হাসিনা সরকার ৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেড ১.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি গোপন চুক্তি সই করে।
আদানি ও শেখ হাসিনার গোপন ‘গোড্ডা চুক্তি’ পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানান, বিদ্যুৎ খাতের বৈশ্বিক মান অনুযায়ী আদানির ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেশি। এছাড়া বাংলাদেশের পাইকারি বিদ্যুতের যে বাজার মূল্য তার চেয়ে ৫ গুণ বেশি দামে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করা হয়েছে। অথচ এই চুক্তি দেখেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশের জনগণের বাহাবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছে। যা দেশের মানুষের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানান, গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি যেহেতু একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাই আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কয়লার দাম নির্ধারণ। সরকার দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে কয়লার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়ে গেলেও সরকার নির্দিষ্ট অর্থের বেশি টাকা দেয় না। কিন্তু আদানির সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী পরিশোধ করার চুক্তি করেছিল। যে কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কয়লার দাম তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় এ জন্য বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে।
অথচ গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্বাভাবিক দরে কয়লা সরবরাহ করা আদানির পক্ষে বড় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ ভারতের ছত্রিশগড় ঝাড়খন্ড এবং পরিসা রাজ্যে আদানি গ্রুপের বিশাল বিশাল কয়লা খনি আছে। এমনকি ভারতের কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া ছয়টি খনির মধ্যে চারটি খনির ঠিকাদারি পেয়েছে আদানির কোম্পানি। শুধু তাই নয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে থাকা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কয়লা খনিও আদানি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে।
আদানি গ্রুপের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তারা বছরে ৯ কোটি টন কয়লা উৎপাদন করতে পারে। আগামী ৩০ বছরে তারা ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুত করার সক্ষমতা রাখে। গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের তথ্য মতে, গৌতম আদানির কোম্পানি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কয়লা খনির মালিক।
ভারতে এত কয়লার মালিকানা থাকার পরও আদানি পাওয়ার চুক্তিতে দেখিয়েছে যে, তারা প্রতিবছর ৭০ লাখ টন কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করবে। আর এত বিপুল পরিমাণ কয়লা বিদেশ থেকে আমদানি করলে স্বভাবতই তার দাম বেশি পড়বে। কিন্তু সেখানেও আদানি গ্রুপই লাভবান হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা বিদেশি কয়লার মালিকও আদানি নিজেই। সেইসঙ্গে কয়লা আবার যে বন্দরে খালাস করা হবে সেই সমুদ্র বন্দরও আদানির মালিকানাধীন। বন্দর থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত কয়লা পরিবহণ করার জন্য যে রেললাইন ব্যবহার করা হয় সেই রেল লাইনও আদানির তৈরি। কয়লার প্রতিটি ধাপে আদানির প্রত্যক্ষ ব্যবসা থাকলেও কয়লার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরা হয়েছে গোড্ডা চুক্তিতে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, আদানি গ্রুপ প্রতিটন কয়লার দাম ধরেছে ৪০০ ডলার। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে করা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লার দাম পড়েছে প্রতিটন ২৫০ ডলারের মতো। আদানির প্রতিটন কয়লার যে দাম প্রস্তাব করেছিল, তা রামপাল ও পায়রার চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। আদানির কয়লার দাম বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে উৎপাদন করলে যে বিদ্যুতের দাম হতো ১৩ থেকে ১৪ টাকা, আদানির কাছ থেকে তা ২২ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
অথচ আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ না কেনার কোনো সুযোগ বাংলাদেশের নেই। কেননা বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুযায়ী তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আদানির করা এই চুক্তিটি অবশ্যই প্রতারণা। বাংলাদেশের পক্ষে এই চুক্তির বৈধতা দিয়ে জনগণের সঙ্গে চ‚ড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতার কাজটি করেছেন শেখ হাসিনা সরকারের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী। আদানির কাছ থেকে অধিক দামে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলেও শেখ হাসিনার মাফিয়া সরকারের লোকজন ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে।
এদিকে আদানির গোড্ডা প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ১০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ হাইভোল্টেজ লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। ভারতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিবহণের খরচও বহন করে বাংলাদেশ সরকার। সীমান্ত থেকে আরও ২৯ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবহণ করে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের ঝাড়খণ্ডের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৬ মাস পরে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অনেক কম পরিমাণ বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসতে শুরু করে।
২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কয়লা ও গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ চাহিদার তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল বাংলাদেশের। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ে আদানির বিদ্যুৎ বাংলাদেশের প্রয়োজন হওয়ারই কথা ছিল না। আদানির সঙ্গে চুক্তির আরেকটি হতাশাজনক বিষয় হলো- চুক্তির অর্থ মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে। যখন এ চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিল তখন এক মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৮১ টাকা। আর বর্তমানে ডলারের দাম প্রায় ১২০ টাকা।
গোড্ডা বিদ্যুৎ প্রকল্প চুক্তির শর্তগুলো শুধু বাংলাদেশের জনগণের কাছে গোপন করেই প্রতারণা করা হয়নি। ধূর্ত আদানি গ্রুপ চুক্তির বেশকিছু বিষয় বাংলাদেশ সরকারের কাছেও গোপন করেছে। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে গৌতম আদানি ২০১৯ সালে গোড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জমি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করিয়ে নেয়। এর ফলে আদানি পাওয়ার ভারতের সব ধরনের শুল্ক কর ছাড় পেয়ে যায়। চুক্তি অনুযায়ী, কর মওকুফের বিষয়টি ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশকে জানানোর কথা ছিল। কারণ শুল্ক কর ছাড়ের কারণে কয়লার আমদানি ব্যয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ কমে যাবে। কিন্তু আদানি পাওয়ার বিষয়টি গোপন করে রাখে। সব মিলিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির করা চুক্তিটি বাংলাদেশের গলায় ফাঁসের দড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যাযাদি/ এসএম