২০২৪ সালের শেষে দেশের বিমা খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৭.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালে এর হার ছিল ৯.১ শতাংশ।অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতা এই ধীরগতির মূল কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিমা খাতে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ হয়েছে ১৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, যা আগের বছর ২০২৩ সালে ছিল ১৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।
লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ সামান্য হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে, যেখানে ২০২৩ সালে এ অঙ্ক ছিল ১২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, নন-লাইফ বিমা খাত কিছুটা প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। ২০২৪ সালে এই খাতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ৫ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরজুড়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। ডলার সংকটের কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে পারেনি, শুধুমাত্র অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল।
নন-লাইফ বিমা খাত মূলত ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। তবে ব্যাংক খাত নিজেও গত বছর সংকটে ছিল, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিমা প্রিমিয়াম সংগ্রহেও।
একইভাবে, জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর জন্যও প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল কঠিন। নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করা যেমন কঠিন ছিল, তেমনি কিছু পুরনো গ্রাহকও প্রিমিয়াম দিতে ব্যর্থ হন।
তবে সব কোম্পানির পরিস্থিতি একরকম ছিল না—কিছু প্রতিষ্ঠান অনিশ্চয়তার মাঝেও ভালো করেছে। ২০২৪ সালে, মেটলাইফ বাংলাদেশ দেশের সব জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে।
মেটলাইফ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা বলেন, 'অন্যান্য খাতগুলোর মতো বিমা খাতও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। তবে প্রিমিয়াম সংগ্রহের ধারা অব্যাহত থাকা একটি ইতিবাচক দিক, যা জনগণের বিমা বিষয়ে আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'মেটলাইফের ৩ হাজার ৩০০ কোটির বেশি প্রিমিয়াম সংগ্রহ গ্রাহকের আস্থার প্রতিফলন। আমরা ডিজিটাল পেমেন্টে বিনিয়োগ করে প্রিমিয়াম পরিশোধ আরও সহজ করেছি। বর্তমানে আমাদের ৭০ শতাংশের বেশি প্রিমিয়াম ডিজিটাল মাধ্যমে পরিশোধ হয়।'
ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ২০২৪ সালে ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে, যা ২০২৩ সালের ১ হাজার ৮৬০ কোটির তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি।ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা মানজার নাদিম বলেন, 'ডলার সংকট ও এলসি খোলার হার কমে যাওয়ায় নন-লাইফ বিমা খাত গত বছর ভালো করতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় মেরিন ইন্স্যুরেন্স ব্যবসা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যায়। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এই খাতে ভালো প্রবৃদ্ধির সুযোগ ছিল।'
আইডিআরএ–এর উপপরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলাইমান বলেন, 'ছয়টি জীবন বিমা কোম্পানি সময়মতো পলিসি হোল্ডারদের ক্লেইম পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। তাদেরকে তিন মাসের মধ্যে ক্লেইম নিষ্পত্তির একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে বলা হয়েছে। ব্যর্থ হলে আইডিআরএ কঠোর ব্যবস্থা নেবে।'
এই ছয়টি কোম্পানি হলো- ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বাইরা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
প্রতিটি কোম্পানিকে বলা হয়েছে তারা কত টাকা তিন মাসে পরিশোধ করতে পারবে এবং তারা কী ধরনের আর্থিক সংকটে রয়েছে, তা বিস্তারিত জানাতে হবে।
সোলাইমান বলেন, 'এসব কোম্পানি দাবি করছে যে রাষ্ট্রায়ত্ত পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা কর্পোরেশন (এসবিসি) সময়মতো তাদের অংশের ক্লেইম পরিশোধ করে না, ফলে তারা নিজেরাও গ্রাহকদের ক্লেইম দিতে পারছে না।'
তিনি জানান, 'আইডিআরএ ইতোমধ্যে এসবিসিকে বিষয়টি জানিয়েছে এবং নতুন নেতৃত্ব এই সমস্যা কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছে।'
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো প্রায় ৩৪ শতাংশ ক্লেইম পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে প্রায় ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়ে গেছে।
অন্যদিকে, নন-লাইফ বিমা খাতে ৬৮ শতাংশ ক্লেইম এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। ফলে বহু পলিসি হোল্ডার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।