টানা দরপতনের মধ্যে আটকে রয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। দিন যত যাচ্ছে, শেয়ারবাজার তত তলানিতে নামছে। অব্যাহত দরপতনের মধ্যে পড়ে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে চরম আস্থার সংকটও দেখা যাচ্ছে। ফলে লেনদেনের গতিও কমে যাচ্ছে। এতে বিনিয়োগকারীদের নিরব রক্তক্ষরণ বেড়েই চলেছে।
আগের কার্যদিবসের ধারাবাহিকতায় সোমবার (২৬ মে) প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দরপতন হয়েছে। ফলে কমেছে মূল্যসূচক। এর মাধ্যমে চলতি সপ্তাহে লেনদেন হওয়া তিন কার্যদিবসেই শেয়ারবাজারে দরপতন হলো। অব্যাহত পতনের মধ্যে পড়ে ডিএসইর প্রধান সূচক প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে।
২০১৯ সালের শেষদিকে আবির্ভাব ঘটা মহামারি করোনা ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। করোনার প্রভাবে জনজীবনের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন শুরু হয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, টানা ৬৬ দিন শেয়ারবাজার বন্ধ রাখার ঘটনা ঘটে।
করোনা মহামারির সময় দেশের শেয়ারবাজারে যেমন ভয়াবহ দরপতন দেখা গিয়েছিল, এখন আবার সেই ধরনের ভয়াবহ দরপতন দেখা যাচ্ছে। অব্যাহত পতনের মধ্যে পড়ে সোমবার লেনদেন শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসই-এক্স আগের দিনের তুলনায় ১৬ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ৭১৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২০ সালের ১৩ আগস্টের পর সূচকটি এখন সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ ৪ বছর ৯ মাসের মধ্যে ডিএসই’র প্রধান সূচক এখন সর্বনিম্ন অবস্থানে। অন্যভাবে বলা যায়, করোনা মহামারির সময়ে ফিরে গেছে মূল্যসূচক।
প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি কমেছে বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক। বাছাই করা ভালো ৩০ কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক আগের দিনের তুলনায় ৪ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৭৪১ পয়েন্টে নেমে গেছে। তবে ডিএসই শরিয়াহ সূচক আগের দিনের তুলনায় দশমিক ৭৬ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৩৩ পয়েন্টে অবস্থান করছে।
শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের বিষয়ে বিনিয়োগকারী মশিউর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারের পরিস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের নিরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে লোকসানের পাল্লা ততো ভারী হচ্ছে। কোনোভাবেই লোকসান কাভার করা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে পুঁজি নেই হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিনিয়োগ করা পুঁজি অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, তা বলে বোঝানো যাবে না।
তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় বাজারে যেমন ভয়াবহ দরপতন হয়েছিল, এখনো সে দরপতন হচ্ছে। অথচ দেশের অর্থনীতির খাতগুলো দিন দিন ভালো হচ্ছে। কিন্তু শেয়ারবাজার তলানীতেই নামছে। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করার জন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
আরেক বিনিয়োগকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, দিন দিন শেয়ারবাজার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শেয়ারবাজার রক্ষায় কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শেয়ারবাজার নিয়ে কারও যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে একটি দেশের শেয়ারবাজার চলতে পারে না। করোনা মহামারির পর এত খারাপ পরিস্থিতিতে দেশের শেয়ারবাজার আর পড়েনি। ক্ষেত্র বিশেষে বর্তমান পরিস্থিতি করোনা মহামারির থেকেও ভয়াবহ।
তিনি বলেন, করোনা মহামারি যখন শুরু হয়, সে সময় অনেক কোম্পানির শেয়ার দাম বেশ উঁচুতে ছিল। কিন্তু এখন শেয়ারবাজারের প্রায় সব শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত অবস্থায়। এরপরও প্রতিনিয়ত দরতপন হচ্ছে। সিংহভাগ বিনিয়োগকারী এতটাই লোকসানে রয়েছেন যে, শেয়ার বিক্রিও করতে পারছেন না। ফলে তারা প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। যে কারণে বাজারে লেনদেনও তলানীতে নেমেছে।
এদিকে দিনের লেনদেন শেষে সব খাত মিলে ডিএসইতে ১৪৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখাতে পেরেছে। বিপরীতে দাম কমেছে ১৬৮টির। আর ৭৭টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ভালো কোম্পানি বা ১০ শতাংশ অথবা তার বেশি লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৭টির শেয়ার দাম বেড়েছে। বিপরীতে ১০০টির দাম কমেছে এবং ৩৬টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
মাঝারি মানের বা ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়া ৩৮টি কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ার বিপরীতে ৩৯টির দাম কমেছে এবং ৬টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়ার কারণে পচা ‘জেড’ গ্রুপে স্থান হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৩৩টির শেয়ার দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৯টির এবং ৩৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর তালিকাভুক্ত ৩৬টি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১২টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে ৬টির দাম কমেছে এবং ১৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দাম কমলেও ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। অবশ্য লেনদেন তিনশ কোটি টাকার কম হয়েছে। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৮২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ২৩৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এ হিসাবে আগের কার্যদিবসের তুলনায় লেনদেন বেড়েছে ৪৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে টানা ১১ কার্যদিবস ডিএসইতে তিনশ কোটি টাকার কম লেনদেন হলো।
এদিন ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার। কোম্পানিটির ১১ কোটি ২৭ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ারের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১০ কোটি ৯ লাখ টাকার। ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক।
এছাড়া ডিএসইতে লেনদেনের দিক থেকে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে- শাহিনপুকুর সিরামিক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, বিচ হ্যাচারি, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল, এনআরবি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক এবং সোনারগাঁও টেক্সটাইল।
অন্য শেয়ারবাজার সিএসইর সার্বিক মূল্যসূচক সিএএসপিআই কমেছে ৫২ পয়েন্ট। বাজারটিতে লেনদেনে অংশ নেওয়া ১৭৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৩টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৮৩টির এবং ১৮টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। লেনদেন হয়েছে ১১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।