শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শুল্ক বৈষম্যে বিপন্ন দেশীয় কসমেটিকস খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক
  ০৪ জুন ২০২৫, ১৩:৩৭
শুল্ক বৈষম্যে বিপন্ন দেশীয় কসমেটিকস খাত
প্রতীকি ছবি

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশের পর থেকেই দেশীয় কসমেটিকস শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে।

তারা বলছেন, বাজেটে আমদানিকারকদের যেভাবে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতে দেশীয় শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে এবং তৈরি হবে বৈষম্যপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ।

1

দেশে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কসমেটিকস উৎপাদনের প্রচেষ্টা থাকলেও, নানা বাধা-বিপত্তির কারণে তা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। উদ্যোক্তারা মনে করছেন, সরকারের ঘোষিত বাজেট এ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহকে আরও নিরুৎসাহিত করবে।

তাদের অভিযোগ, আমদানিকৃত কসমেটিকস পণ্যের প্যাকেজিংয়ে কোনো শুল্ক আরোপ না থাকলেও দেশীয় উৎপাদনের জন্য সেই একই প্যাকেজিং সামগ্রী আমদানিতে শুল্ক দিতে হচ্ছে ১২৭ দশমিক ৭২ শতাংশ পর্যন্ত।

এর ফলে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। অথচ বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বা নিম্ন ট্যারিফ মূল্যে দেশে এনে বাজার দখল করে নিচ্ছে।

একজন উদ্যোক্তা বলছিলেন, “যখন আমরা বিদেশ থেকে খালি কনটেইনার এনে তাতে পণ্য ভরে বিক্রি করতে চাই, তখন উচ্চ শুল্ক দিতে হয়।

কিন্তু যখন কেউ বিদেশে পণ্য ভর্তি কনটেইনার এনে বাজারে ছাড়ে, তখন তা প্রায় শুল্কমুক্ত। এটা সরাসরি বৈষম্য। একই খাতে দুই রকম নীতি চলতে পারে না।”

সরকারি কাস্টমস এস.আর.ও.-এর (নং ২২৬-আইন/২০২৫/৪৮) বিধান অনুযায়ী, নেট ওয়েট বিবেচনায় নিয়ে প্রতিকেজি পণ্যের একটি নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, একটি লিপস্টিকের প্রতি কেজি নেট ওজনের ভিত্তিতে শুল্ক ধরা হয় ৪০ ডলার। যেখানে একটি লিপস্টিকের গড় ওজন ৪ গ্রাম ধরা হলে প্রতি কেজিতে থাকে ২৫০টি লিপস্টিক। অর্থাৎ প্রতিটি লিপস্টিকের ট্যারিফ মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ২০ টাকা।

সরকার ওই পণ্যে গড়পড়তা ৩১ টাকা শুল্ক পেলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। এতে করে আমদানিকারকরা বিপুল মুনাফা করলেও সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং স্থানীয় শিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিষয়টি শুধু শুল্ক হার নয়, বরং শুল্কায়নের পদ্ধতির সঙ্গেও জড়িত। বিদেশি ব্র্যান্ডের কালার কসমেটিকস পণ্য যখন আমদানি হয়, তখন তা কেবলমাত্র পণ্যের “নেট ওজন” বিবেচনায় কর ধার্য হয়।

অথচ দেশীয় কোম্পানি যখন প্যাকেজিং বা মোড়ক আমদানি করে, তখন সেটিকে আলাদা পণ্য হিসেবে বিবেচনা করে উচ্চ হারে কর ধার্য করা হয়। উদ্যোক্তারা মনে করছেন, এটি একটি দ্বৈত নীতি এবং ব্যবসায়িকভাবে অন্যায্য।

কসমেটিকস খাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশ (এএসবিএমইবি) এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, “বৈষম্যমূলক নীতির কারণেই দেশে আজও এই সম্ভাবনাময় ইন্ডাস্ট্রিটি গড়ে ওঠেনি। অথচ সঠিক নীতি সহায়তা পেলে দেশের বাজারই শুধু নয়, বিদেশেও রপ্তানির বিপুল সুযোগ রয়েছে।”

তিনি জানান, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের কিছু ব্র্যান্ড তাদের কসমেটিকস পণ্য মধ্যপ্রাচ্য, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে রপ্তানির জন্য কার্যক্রম শুরু করেছে।

তিনি মনে করেন, এই খাতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলে শুধু অভ্যন্তরীণ বাজার নয়, বৈদেশিক বাজারেও বাংলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।

স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে একাধিক সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, দেশে উৎপাদনের ফলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, কারণ কম পরিমাণ পণ্য আমদানি করতে হবে। তৃতীয়ত, সরকার উচ্চ হারে রাজস্ব আদায় করতে পারবে, যা আমদানিকৃত পণ্যে এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।

তবে এসব সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন, ট্যারিফ মূল্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনয়ন এবং গ্রস ওয়েট ভিত্তিক শুল্কায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।

উদ্যোক্তারা বলছেন, কনটেইনার বা মোড়কও পণ্যেরই অংশ, তাই শুল্ক নির্ধারণে তার মূল্যও বিবেচনায় নিতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈষম্যমূলক শুল্কনীতির কারণে স্থানীয় কসমেটিকস খাত দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে আছে। সরকারের উচিত, আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীদের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা। নয়তো দেশে উৎপাদিত সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো কখনোই টিকে থাকতে পারবে না, বরং আমদানির উপর নির্ভরশীলতাই বাড়বে।

সবশেষে বলা যায়, সরকার যদি এই বাজেট কাঠামো পুনর্বিবেচনা করে এবং দেশীয় শিল্পের জন্য ন্যায্য ও সমতা ভিত্তিক নীতি গ্রহণ করে, তাহলে এ খাত দেশের রফতানি বাজারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে