শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
জ্বালানি ও উন্নয়ন প্রকল্প 

চড়া সুদে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার

অর্থ-বাণিজ্য রিপোর্ট
  ১৬ মে ২০২৫, ১৬:৪২
আপডেট  : ১৬ মে ২০২৫, ১৮:০৩
চড়া সুদে ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি ও সার আমদানি, বাজেট সহায়তা এবং কয়েকটি বড় উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ জোগাতে ৪.০৭৪ বিলিয়ন (৪০০ কোটির বেশি) ডলারের বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছে সরকার। যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সার, পেট্রোলিয়াম ও এলএনজি আমদানিতে (২৭৫ কোটি ডলার) ব্যয় করা হবে। ঋণ পেতে মানতে হচ্ছে শর্ত।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অনমনীয় ঋণ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

1

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, যেসব প্রকল্প বা পণ্য সংগ্রহে নমনীয় অর্থায়ন সম্ভব হয়নি বা অতীত রেকর্ড বিবেচনায় তা অসম্ভব, সে সকল ক্ষেত্রে অনমনীয় বা কঠিন শর্তের ঋণ নেওয়া হয়।

অন্যদিকে, বাজারভিত্তিক ডলার ঋণের ক্ষেত্রে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (সোফর) বেশি থাকায় – উন্নয়ন প্রকল্প ও বাজেট সহায়তায় সরকার যে ঋণ নিচ্ছে সেগুলোও এখন অনমনীয় ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এছাড়া তেল, গ্যাস বা এলএনজি আমদানি জন্য সরকার মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংস্থা- ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে যেসব ঋণ নেয় সেগুলোও অনমনীয় শর্তেই দেওয়া হয় বলে জানান তারা।

সভায় উপস্থিতি সূত্রে জানা গেছে, অনমনীয় ঋণে অর্থায়নের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যেসব ঋণের ‘গ্রান্ট এলিমেন্ট’ বা অনুদান উপাদান ২৫ শতাংশের নিচে, তা ‘নন-কনসেশনাল’ বা অনমনীয় ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব ঋণের সুদহার বেশি এবং ফেরতের সময়সীমাও কম।

গ্রান্ট এলিমেন্ট মূলত কোনো ঋণের সহজ শর্তের মাত্রা নির্ধারণ করে। এটি হিসাব করা হয়, ঋণের মোট ব্যয় এবং ভবিষ্যতে পরিশোধযোগ্য অর্থের বর্তমান মূল্যের মাঝে ব্যবধানের অনুপাতে, যা শতাংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সতর্ক করে বলেন, এসব ঋণের সুদের হার প্রায় ৬ শতাংশের মতো, যা নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল। “এগুলোকে ‘ব্যয়বহুল’ যদি না-ও বলি, তারপরও এগুলো মূলত বাণিজ্যিক সুদ হারে নেওয়া ঋণ।

প্রশ্ন হলো, এসব ঋণ দিয়ে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে কী পর্যাপ্ত রিটার্ন পাওয়া যাবে কি-না, যাতে ঋণ পরিশোধ সম্ভব হয়। কারণ যথাযথ রিটার্ন না এলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশ” - যোগ করেন তিনি।

সরকারের ঋণ নেওয়ার মানদণ্ড হিসেবে মূলত ঋণ-জিডিপি অনুপাত বিবেচনায় নেওয়া হয় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এসব ঋণ অনুমোদনের আগে আরও বিস্তৃত সূচকগুলি পর্যালোচনা করা দরকার।’

সরকারের একটি বিদ্যমান গাইডলাইনের কথা উল্লেখ করেন তিনি, যেখানে বলা হয়েছে, প্রতি বছর অনমনীয় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ যেন রপ্তানি আয়ের ১০ শতাংশ বা রাজস্ব আয়ের ১৫ শতাংশ এরমধ্যে যেটি কম, তার মধ্যে সীমিত থাকে।

এছাড়া, ঋণের তুলনায় বৈদেশিক আয়ের অনুপাতের মতো সূচকগুলোও ঋণ টেকসইতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত’, বলে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের অংশ হিসেবে, আগামী অর্থবছরে সরকার প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণে সার আমদানি করতে যাচ্ছে। ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে মোট ৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাচ্ছে।

এরমধ্যে ২০ কোটি ডলার ইতোমধ্যে নিশ্চিত এবং বাকি ৩০ কোটি ডলার সম্ভাব্য। এই ঋণের পরিশোধ মেয়াদ এক বছর এবং সুদের হার সোফর + ১.৮০ শতাংশ। এর সঙ্গে ০.২ শতাংশ প্রশাসনিক ফি প্রযোজ্য হবে। ২০২৫ সালের ৯ মে তারিখে সোফর এর হার ছিল ৪.২০৪ শতাংশ, সে অনুযায়ী এই ঋণের সম্ভাব্য বার্ষিক সুদের হার প্রায় ৬ শতাংশ।

উচ্চ সুদের হার ও স্বল্প মেয়াদে পরিশোধযোগ্য হওয়ায় এই ঋণও অনমনীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পেট্রোলিয়াম পণ্য ও এলএনজি আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে বাংলাদেশ ২২৫ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে।

এরমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল আমদানির জন্য নিচ্ছে ১৬৫ কোটি ডলার এবং এলএনজি আমদানিতে পেট্রোবাংলা নিচ্ছে ৬০ কোটি ডলার।

প্রতিটি অর্থছাড়ের তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে, এবং সুদের হার হবে সোফর + ১.৭৫ শতাংশ, যা প্রায় ৬ শতাংশ।

গতবছর একই উদ্দেশ্যে সরকার আইটিএফসি থেকে ২১০ কোটি ডলার ঋণ নেয় এরমধ্যে ১৬০ কোটি ডলার তেল এবং ৫০ কোটি ডলার নেওয়া হয় এলএনজির জন্য। ইআরডি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত আইটিএফসি বাংলাদেশকে মোট ২১.৬৭৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।

ব্যাংক খাত সংস্কারে ‘প্রস্তাবিত স্ট্যাবিলাইজিং অ্যান্ড রিফর্মিং দ্য ব্যাংকিং সেক্টর প্রোগ্রাম (সাব-প্রোগ্রাম-১)’ আওতায় এডিবি থেকে ৫০ কোটি ডলারের অনমনীয় ঋণ অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এটি সংস্থাটির অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্সেস (ওসিআর রেগুলার) বা বাজারভিত্তিক ভাসমান সুদহারের ঋণ।

ইআরডির বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঋণের সোফর রেট ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ প্লাস স্প্রেড দশমিক ৫০ শতাংশ হওয়ায়— কার্যত সুদহার হবে ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১২ বছরে।

এর সঙ্গে দশমিক ১৫ শতাংশ প্রতিশ্রুতি ফি-ও যুক্ত হবে। গ্রান্ট এলিমেন্ট মাত্র ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ হওয়ায়— এই ঋণও অনমনীয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য ব্রিকস দেশগুলোর নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) প্রথম ঋণ প্রস্তাবও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ঋণের পরিমাণ ৩২ কোটি ডলার এবং ‘এক্সপান্ডেড ঢাকা সিটি ওয়াটার রেজিলিয়েন্স’ প্রকল্প বাস্তবায়নে এ তহবিল ব্যবহার করা হবে বলে ইআরডি সূত্র জানায়।

ইআরডি বলছে, যেহেতু এনডিবি বাজারভিত্তিক সুদ হারে ঋণ দেয়, এবং বর্তমানে ডলার ঋণের ক্ষেত্রে সোফর রেট বেশি হওয়ায় এটিও অনমনীয় ঋণ।

ইতোমধ্যে এনডিবির সাথে ঋণচুক্তিসহ অন্যান্য দলিলের বিষয়ে গত ১৮ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে আলোচনা সম্পন্ন হয়। এই ঋণটি ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। এরমধ্যে সাড়ে ৭ বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকবে। এছাড়া ফ্রন্ট এন্ড ফি দিতে হবে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ, এছাড়া প্রতিশ্রুতি ফি ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।

মার্কিন ডলার, ইউরো এবং চীনের আরএমবি (ইউয়ান) তিনটি মুদ্রায় এ ঋণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তবে শুধুমাত্র চীনের মুদ্রায় নিলেই নমনীয় শর্তের আওতায় আসবে। মার্কিন ডলার ও ইউরোর ক্ষেত্রে নেগেটিভ বা নিম্ন গ্রান্ট এলিমেন্ট রয়েছে (যথাক্রমে মাইনাস ১২.৩৭ শতাংশ ও ১৬.১৬ শতাংশ), সে তুলনায় আরএমবিতে ২৮ শতাংশ গ্রান্ট এলিমেন্ট পাওয়া যাবে। ডলারের ঋণের জন্য বার্ষিক সুদহার হবে ৫.৮৫ শতাংশ।

সরকার এডিবি থেকে আরও দুটি অনমনীয় ঋণ অনুমোদন করেছে। প্রথমটি ২০ কোটি ডলারের ‘পাওয়ার ট্রান্সমিশন স্ট্রেংদেনিং অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন অব রিনিউয়েবল এনার্জি প্রজেক্ট’-এর জন্য।

এ ঋণের মেয়াদ ২৫ বছর, গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর, সুদের হার সোফর + ০.৬০ শতাংশ, ০.১০ শতাংশ ম্যাচিউরিটি প্রিমিয়াম এবং ০.১৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি। এই ঋণের গ্রান্ট এলিমেন্ট -০.২২ শতাংশ।

দ্বিতীয়টি ২০৪ মিলিয়ন ডলারের ‘সাসেক ঢাকা-নর্থওয়েস্ট করিডোর রোড ফেজ ২-ট্রাঞ্চ ৪ প্রজেক্ট’-এর জন্য। ২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল সোফর অনুযায়ী, এর গ্রান্ট এলিমেন্ট ১.২৫ শতাংশ, ফলে এটিও অনমনীয়।

সড়কের এই প্রকল্প সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘গ্যাস আমদানির জন্য নেওয়া ঋণ সরাসরি উৎপাদনে কাজে লাগবে, কারণ গ্যাস কারখানাগুলোতে ব্যবহৃত হবে, শিল্পে সহায়ক হবে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করবে।

এমন খাতে বাজারভিত্তিক ঋণ যৌক্তিক। তবে সড়কের করিডোর প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায় এসব প্রকল্প আদৌ অর্থনীতিতে কী ধরনের রিটার্ন দেবে বা প্রবৃদ্ধিতে কার্যকর অবদান রাখবে?’

‘স্ট্রেংদেনিং ইকোনমিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স প্রোগ্রাম’-এর আওতায় ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট থেকে ৯৬.১ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১০ কোটি ডলার) বাজেট সহায়তা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে এসসিএনসিএল।

এই ঋণের মেয়াদ ১৮ বছর, যার মধ্যে তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড। সুদের হার ইউরিবোর + ১.২০ শতাংশ বেসিস পয়েন্ট। এতে ফ্রন্ট এন্ড ফি না থাকলেও ০.২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট চার্জ প্রযোজ্য হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে