সর্বশেষ বৈঠকেও সুদহার অপরিবর্তিত রেখেছে ফেডারেল রিজার্ভ। মার্কিন অর্থনীতিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রভাবের ওপর সতর্ক পর্যবেক্ষণ বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অবশ্য চলতি বছরে সুদহার দুবার কমতে পারে এমন পূর্বাভাসও দিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। তবে সতর্কবার্তা দিয়ে ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেছেন, ‘উচ্চ আমদানি শুল্ক আরোপ হলে সামনে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সুদহার নাও কমতে পারে।’ এদিকে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি মিলিয়ে মুদ্রা বাজারে ডলারের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। খবর রয়টার্স।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সুদহারের সীমা ৪ দশমিক ২৫ থেকে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত বছর ফেড তিনবার সুদহার কমিয়েছে, সর্বশেষ কমানো হয়েছিল ডিসেম্বরে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুদিনের বৈঠকের পর বুধবার সংবাদ সম্মেলনে জেরোম পাওয়েল জানান, সুদহার কমানো বা বাড়ানোর বিষয়ে কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নন। এ সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।
এর আগে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সুদহার কমানোর বিষয়ে দ্রুত পূর্বাভাস দিলেও এখন তাতে কিছুটা ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শ্লথগতি, বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতি এবং মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখিতার আশঙ্কা বেড়েছে।
জেরোম পাওয়েল আরো জানান, যদি শুল্ক বা মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি না থাকত, তাহলে বর্তমান মূল্যস্ফীতির যে অবস্থায় রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার কমাতে পারত।
আগামী মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক প্রয়োগ হতে পারে। বিষয়টি উল্লেখ করে ফেড চেয়ারম্যান জানান, সামনে ব্যয়জনিত একটি ধাক্কা আসছে। কারণ কে শুল্কের খরচ বহন করবে তা নিয়ে উৎপাদক, প্রস্তুতকারক ও খুচরা বিক্রেতারা এখনো টানাপড়েনে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত শুল্কের খরচের একটি অংশ ভোক্তার ঘাড়েই চাপবে।
জেরোম পাওয়েলের মতে, কয়েক মাস অপেক্ষা করলে শুল্কজনিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব বোঝা যাবে। এরপর সুদহার বিষয়ে আরো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
সুদহার অপরিবর্তিত রাখার মাধ্যমে মূলত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আহ্বান উপেক্ষা করেছে ফেড। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মতে, এখনই সুদহার কমালে তাদের মূল লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে ফেরানোর পরিপন্থী হবে। বিশেষ করে যখন শুল্কজনিত পরিবর্তনগুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি এবং তাদের প্রভাব পরিষ্কার নয়। গত বুধবার জেরোম পাওয়েলকে ‘মূর্খ’ অভিহিত করে ট্রাম্প জানান, সুদহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা উচিত। এমনকি নিজেই ফেডের চেয়ারম্যান হয়ে বসতে পারেন বলে হুমকি দেন।
ফেডের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে নীতিনির্ধারকরা পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি বছর মার্কিন অর্থনীতিতে মৃদু স্থবিরতা দেখা যেতে পারে। ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি হবে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৫ এবং বছর শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এ পূর্বাভাস মার্চে দেয়া পূর্বাভাস ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কম। ওই সময় বেকারত্বের পূর্বাভাস ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে এখন পর্যন্ত বেকারত্বের হার কম এবং শ্রমবাজার যথেষ্ট শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেছে ফেড।
নীতিনির্ধারকরা চলতি বছরে ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদহার কমানোর পূর্বাভাস অপরিবর্তিত রেখেছেন। তবে এরপর সুদহার কিছুটা ধীরগতিতে কমতে পারে। মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের লক্ষ্যে ফেরাতে সুদহার ২০২৬ ও ২০২৭ সালে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমতে পারে। তবে ফেডের ১৯ নীতিনির্ধারকের মধ্যে সাতজন মনে করেন, চলতি বছর সুদহার কমানোর প্রয়োজন হবে না।
বিনিয়োগ সংস্থা ব্র্যান্ডিওয়াইন গ্লোবালের পোর্টফোলিও ম্যানেজার জ্যাক ম্যাকইনটায়ার বলেন, ‘মার্কিন অর্থনীতিতে এখনো স্থবিরতার দিকে ঝোঁক রয়েছে। প্রবৃদ্ধি কম এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ ও স্থায়ী। সুদহার কমানোর দিকে ঝুঁকে থাকলেও ফেড এখনো ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে।’
ফেডের বিবৃতিতে ইসরায়েল-ইরান সংকট এবং বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজার ও অন্যান্য বাজারের ঝুঁকি বৃদ্ধির উল্লেখ নেই। তবে ফেড চেয়ারম্যান জানান, সংঘাতের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত এমন মূল্যবৃদ্ধি স্বল্পস্থায়ী হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে না।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে বড় সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে ফেডের সতর্কবার্তার মাঝে মুদ্রাবাজারে ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক উত্তেজনা দ্রুত ডলারকে আবারো ‘নিরাপদ মুদ্রা’র অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছে। এটি ইয়েন, ইউরো ও সুইস ফ্রাঁর তুলনায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওসিবিসির কারেন্সি স্ট্র্যাটেজিস্ট ক্রিস্টোফার ওং বলেন, ‘ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের কারণে ফেডের সুদহার বিষয়ক খবর অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। মানুষ আর ঝুঁকি নিতে চাইছে না, যা ঝুঁকিপূর্ণ মুদ্রাগুলোর দরপতনে ভূমিকা রাখছে।’
গতকাল ইউরোর বিনিময় হার দশমিক ২৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ১৪৫৫ ডলারে, যা ফেব্রুয়ারির পর থেকে মুদ্রা বিনিময় হারে সবচেয়ে বড় সাপ্তাহিক পতন। জাপানি ইয়েনের বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১ ডলারে ১৪৫ দশমিক ১৩ ইয়েন। অন্যদিকে ছয়টি প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯, যা সপ্তাহজুড়ে প্রায় দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। এটি জানুয়ারির পর থেকে ডলারের সবচেয়ে শক্তিশালী সাপ্তাহিক অবস্থান।