শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

অডিও ফাঁস: শিক্ষক জনির অনুগ্রহেই চেয়ারে বসেছেন জাবি উপাচার্য

জাবি প্রতিনিধি
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:৪৬
অডিও ফাঁস: শিক্ষক জনির অনুগ্রহেই চেয়ারে বসেছেন জাবি উপাচার্য

যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করার একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। তার কারণেই অধ্যাপক নূরুল আলম উপাচার্যের চেয়ারে বসেছেন বলে অডিওতে মন্তব্য করেছেন শিক্ষক জনি।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও আরেক সহকারী প্রক্টরের সহযোগিতায় একই বিভাগের ৪৩ ব্যাচের ভুক্তভোগী এক ছাত্রীকে জোরপূর্বক দায়মুক্তিপত্র লেখানো ও তা প্রত্যাহার চেয়ে উপাচার্য বরাবর আবেদনপত্র এবং ‘যৌন নিপীড়ক জনিকে বাঁচাতে তৎপর উপাচার্য, নেপথ্যে (অডিও)’ শিরোনামে একটি উড়োচিঠি সাংবাদিকদের নিকট পাঠানো হয়েছে।

সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) কুরিয়ারযোগে সাংবাদিকদের কাছে এই ডকুমেন্ট পাঠানো হয়। সেখানে উপাচার্যকে গালিগালাজ করার অডিও ক্লিপ সম্বলিত একটি ডিভিডি, দায়মুক্তিপত্র প্রত্যাহার সংক্রান্ত আবেদনপত্র ও একটি উড়োচিঠি পাওয়া যায়। পার্সেলে প্রেরকের পরিচয় না থাকলেও উড়োচিঠির নিচে লেখা হয়, ‘ধন্যবাদান্তে: প্রক্টরিয়াল বডির একজন সদস্য’। বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে অডিও ক্লিপটি শিক্ষক জনির বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

৫২ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপে মাহমুদুর রহমান জনিকে বলতে শোনা যায়, ‘বাট ইউ ফরগেট, আই ওয়াজ ওয়ান্স আপন এ টাইম, আই ওয়াজ দ্য এক্স প্রেসিডেন্ট অফ বিএসএল-জেইউ। আমি হয়তো ধরা খাবো, ধরা খাবো না এমন বলছি না। কিন্তু ধরা খাওয়ার আগে আমি চার-পাঁচটা মুখ শেষ করে দিবো।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘এন্ড ভিসিকে আমি একজনকে দিয়ে রিচ করেছিলাম, ভিসি বলছে যে আমি ওকে বহিষ্কার করে দিচ্ছি, সাসপেন্ড করে দিচ্ছি। ওকে আইনের আশ্রয় নিতে বলো।’

অডিও ক্লিপের ৩২ সেকেন্ডের পর মাহমুদুর রহমান জনি ভিসিকে নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। মদ্যপ অবস্থায় তিনি বলতে থাকেন অশ্লীল ভাষায় কথা বলে, যেহেতু আমাকে আইনের আশ্রয় নিতে বলছে, আমাকে নাকি বহিষ্কার করে দিচ্ছে, ইউনিভার্সিটি থেকে। তাই আমাকে বলা হয়েছে আইনের আশ্রয় নিতে। তবে ওই মাদারচো‘ (উপাচার্য) যে আমার জন্য চেয়ারে বসেছে, সেটা সে ভুলে গেছে।’

এছাড়াও ডকুমেন্টের সাথে গত ১৬ই জানুয়ারি উপাচার্য বরাবর লিখিত পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের ভুক্তভোগী ছাত্রী স্বাক্ষরিত পাঁচ পৃষ্ঠার একটি আবেদনপত্র পাওয়া গেছে। ‘ইতোপূর্বে ২৪ নভেম্বর ২০২২ ইং তারিখে আপনার বরাবর আমি যে লিখিত দরখাস্ত দিয়েছি তা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে’ শীর্ষক ঐ আবেদনপত্রের ৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়, ‘জনি আমাকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান এবং প্রক্টর স্যারের কাছে পরামর্শ নেওয়া হয় কিভাবে দরখাস্ত লেখা যায়। প্রক্টর স্যার কিছু পয়েন্ট বলে দেন এবং গুছিয়ে লিখতে বলেন। আরেকজন সহকারী প্রক্টর মহিবুর রৌফ শৈবাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। লেখার সময় কিছু সাংবাদিক প্রক্টর অফিসে চলে আসে তাই আমাকে বের করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় শৈবাল স্যারের গাড়িতে। এরপর বাকি লেখা সম্পন্ন করা হয়। পরেরদিন প্রক্টর স্যারের বাসায় আপনার (উপাচার্য) অনুমতিতে জমা দিয়ে আমি লন্ডন চলে যাই।’

তবে দায়মুক্তিপত্র লেখিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান। এমনকি উপাচার্যকে গালমন্দ ও নিয়োগে শিক্ষক জনির প্রভাব সম্পর্কিত অডিও ক্লিপের ব্যাপারেও তিনি জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে, তার সাথে এমন কোন কথাবার্তা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।’

তবে সেসময় ভুক্তভোগী ছাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান জনি বিভিন্ন চাপের মুখে পড়ার পর আমি যেন বিষয়টি স্বীকার না করি সেজন্য আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় এবং বলে যদি এসব কিছু ঠিক হয়ে যায় তাহলে সে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি দিবে। এই বলে সে আমার কাছ থেকে উপাচার্য বরাবর চার পৃষ্ঠার একটি দায়মুক্তিপত্র লিখিয়ে নেয়। তবে পরবর্তীতে সে কথা রাখেনি এবং যথারীতি সে একজন প্রতারক। সব সত্য বিষয়গুলো আমি সবার সামনে আনতে চাই।’

উল্লেখ্য, মাহমুদুর রহমান জনি ২০১২ সালে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগে নিয়োগ পান তিনি। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীল সঙ্গে ‘অনৈতিক’ সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ উঠে। সর্বশেষ গত বছরের ২১ শে নভেম্বর মাহমুদুর রহমান জনি ও একই বিভাগে সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রভাষক আনিকা বুশরা বৈচি’র একটি অন্তরঙ্গ ছবি (সেলফি) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করা হয়। এর প্রেক্ষিতে জনির বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। পরে ৮ ডিসেম্বর একাধিক ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে জনির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তখন চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

তবে চলতি বছর জানুয়ারিতে একই বিভাগের ৪৩ তম ব্যাচের ভুক্তভোগী আরেক ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে জনির পক্ষে ‘দায়মুক্তিপত্র’ লেখানোর অভিযোগ ওঠে। পরে ৯ ফেব্রুয়ারি অভিযোগের ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এরপর ১ মার্চ এক চিঠিতে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি পাঠায় ইউজিসি। তখন আগের কমিটির রিপোর্ট পূর্ণাঙ্গ হয়নি মর্মে ১৩ মার্চ পুনরায় স্পষ্টীকরণ কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর এই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে গত ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় জনির বিরুদ্ধে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান রীতি অনুসারে, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠিত হয়। তবে জনির ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। এ বিষয়ে সে সময় একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য ‘জনির বিরুদ্ধে সবকটি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে’ মর্মে জানায় এবং এর প্রেক্ষিতে কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্য সভা চলাকালীন জনির শাস্তি দাবি জানান। তবে জনিকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি সিন্ডিকেটের সভাপতি উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম সুকৌশলে এড়িয়ে যান।

এ বিষয়ে শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কারও সাথে আমার এ ধরণের কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আমি উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার কে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপাচার্যকে নিয়োগ দিয়েছেন। আর তিনি একজন সজ্জন ব্যাক্তি। তাকে গালমন্দের কোন কারণ নেই।’

জোরপূর্বক দায়মুক্তিপত্র লেখানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি যদি কোন ঘটনায় দায়ী হতাম তাহলে দায়মুক্তিপত্র লেখানোর ব্যাপারটা আসতো। আমি তো এ ধরণের কোন কাজে দায়ী না। যেখানে আমার কোন দায়ই নেই, সেখানে দায়মুক্তিপত্র লেখানোর প্রশ্নই আসে না।’

এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

যাযাদি/ এম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে