রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চিড়িয়াখানায় ছয় বন্ধু ও স্মৃতি ভরা যাত্রা

বাকৃবি প্রতিনিধি
  ২৪ মে ২০২৫, ২১:১৯
চিড়িয়াখানায় ছয় বন্ধু ও স্মৃতি ভরা যাত্রা
ছবি: যায়যায়দিন

সবাইকে সকাল ৬টায় ক্যাম্পাসের হ্যালিপ্যাডে উপস্থিত থাকতে হবে। আজিমুন নাহার ম্যামের কড়া নির্দেশ। দেরি করলে আর ট্যুরে যাওয়া হবে না। মোটামুটি একটি নির্ঘুম রাত কাটানোর পরেও ৩ মিনিট লেট! ভাগ্য ভালো বাস ৬টার সময়েই ছাড়ে নি। বাস ছাড়তে ছাড়তে সাড়ে ৬টা বেজে যায়।

জীবনের সব দিন একরকম হয় না। কিছু দিন হৃদয়ের পাতায় স্থায়ীভাবে গেঁথে থাকে। পড়ালেখা, ক্লাস, ল্যাব, টিউটোরিয়াল আর পরীক্ষার চাপে যখন নিশ্বাস নেওয়ারও ফুরসত নেই, তখন হঠাৎ পাওয়া এক বিকেল হয়ে ওঠে জীবনের রঙিন পরশ। বলছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা। সে সফর শুধু শিক্ষামূলক ছিল না, ছিল ভালোবাসা, আবিষ্কার ও বন্ধুত্বের এক মহোৎসব।

1

সেই সফরের গল্প বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের, ছয় গ্রুপমেটের কথা- আমি (আশিক), সোহান, তূর্য, মালয়েশিয়ান হানিফ, মাসুম আর স্বাধীন। আমরা সেদিন ঘুরেছি একসাথে নয়, নিজেদের মতো করে। কারণ প্রতিটি প্রাণির চোখে, আচরণে, চলাফেরায় আমরা খুঁজে নিচ্ছিলাম আমাদের পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠা থেকে বাস্তবের প্রাণ।

সকাল সাড়ে ৮টায় গাজীপুরের হোতাপাড়ায় ছোট্ট একটি বিরতি দিয়ে সকাল ১১টায় পৌঁছে যাই গন্তব্যে। এর মাঝে বাসে সকালের নাস্তা ও এটেন্ডেন্স নিয়ে নেয়া হয়েছে। আর বাসের মধ্যে কখনো বাংলা, কখনো হিন্দি, কখনো ইংরেজি গানে চলেছে যার যার মতো নাচানাচি। তবে নাচের মধ্য মণি ছিলো সুমন চক্রবর্তী। ডাকসাইটে তার নাম ‘'অগ্নি বালক’। অগ্নি বালক নাচের মধ্যেও অগ্নি ঝড়িয়েছে।

চিড়িয়াখানায় পৌঁছে আমাদের শিক্ষকরা আমাদের প্রয়োজনীয় ব্রিফ্রিং দিয়ে দেন। এরপর সবাই দলছুট। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সোহান আর তূর্য ছাড় কেউ নেই। তবে একে একে পেলাম হানিফ, মাসুম আর স্বাধীনকে।

আমাদের সবার আগে সময় কেটেছে চিত্রা হরিণের প্রাঙ্গণে। হরিণের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, তাদের দু চোখ ভরা বন্দি জীবনের দুঃখ, তবে তাদের চোখে ভয় নেই-আছে শুধু নির্ভরতা আর সরলতা। হরিণগুলোর লাফিয়ে বেড়ানো, মাথা দোলানো, তৃণভোজ-সবকিছুতেই ছিল একরাশ শান্তি। আমরা দেখছিলাম, শিখছিলাম-বিনিময়ে কিছু বলছিল না ওরা, কিন্তু অনেক কিছু শোনাচ্ছিল।

এরপর আমাদের সময় কাটে চিড়িয়াখানার বিশাল লেকের সামনে। লেক ভিউয়ের সামনে আমরা দাঁড়ানোর পরই প্রকৃতি আমাদের আমন্ত্রণ জানায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাধ্যমে। লেকের সবুজ পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছিলো বিশাল আকৃতির সাদা বক দম্পতি। মন নিমিষেই ভালো করার মতো পরিবেশ দ্বারা আমাদের স্বাগতম জানিয়েছিল প্রকৃতি।

এরপর আমাদের যাত্রা থামল সিংহীর খাঁচার সামনে। বিশালাকৃতির সিংহীটি বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ একসময় মাথা উঁচু করে আমাদের দিকে তাকাল সে। সে দৃষ্টিতে ছিল দম্ভ, ছিল আত্মবিশ্বাস, আর ছিল এক শীতল শাসন। “এই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়েও গায়ে কাঁটা দেয়,” বলল মাসুম। এক পর্যায়ে খাচার বাইরে হাত দিয়ে সিংহীর দম্ভের সামনে এক অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা যায় তাকে। একটু পরেই সিংহীটি ঝোপের মধ্যে কিছু একটা ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরে দেখা যায় সে একটি গুইসাপ শিকারের চেষ্টা করছিলো। সত্যি কথা বলতে এই প্রথম আমরা কোনো সিংহ বা বাঘ প্রজাতির প্রাণীকে দেখলাম শিকার করতে। যদিও সিংহীটি শিকারে ব্যর্থ হয়। সে আবার চুপচাপ গুইসাপটিকে লক্ষ্য করেই বসে রইলো। মনে মনে যেনো বলছিলো, আমি বসলাম দেখি তুই কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারিস। আমরা কেউ কোনো শব্দ করলাম না, কিন্তু বুঝে নিলাম-প্রাণিরাও জানে, কাকে কিভাবে দেখতে হয়। রাজকীয় এই প্রাণী আমাদের শেখাল দৃঢ় সংকল্পের ভাষা-নিঃশব্দ, কিন্তু গভীর।

এরপরেই আমরা গেলাম রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাচার সামনে। রাজার হালে সে বসে রয়েছে। কিন্তু আমরা যাওয়ার পরেই সে বসা থেকে উঠে ঝোপের মধ্যে চলে গেলো। স্বাধীন আক্ষেপ করে ত বলেই ফেললো, ভাগ্যই ভালো না আমাদের। একটাও ছবি তুলতে পারলাম না। কিন্তু তূর্য বললো, আমাদেরই ভাগ্য ভালো। কারণ ওকে আমরা হাটতে দেখলাম, ঘুরে বেড়াতে দেখলাম।

সবচেয়ে বেশি হাসির খোরাক জুগিয়েছে বানরের দল। কখনো উঁচু গাছ বেয়ে ওঠে, কখনো খাবার নিয়ে ঝগড়া করে, কখনো আবার দর্শকদের খুশি করতে ভঙ্গিমা করে। তূর্য বলল, “দেখলে তো? বানরেরা মানুষ নাকি মানুষ বানর-বুঝা দায়!”

এরপর তূর্য বায়না ধরলো সে জলহস্তি দেখবে। তাকে সবাই মিলে নিয়ে গেলাম জলহস্তি দেখাতে। গিয়ে দেখি জলহস্তিগুলো কাদা পানিতে ডুবে রয়েছে। আমরা ত বলেই ফেললাম, কাদার মধ্যে বড় বড় বস্তা ভেসে রয়েছে।

এরপর গেলাম সাপের দিকে। সবচেয়ে যে বিষয়টি খারাপ লেগেছে সেটি হলো চিড়িয়াখানাতে অজগর ছাড়া অন্য প্রজাতির সাপ নেই বললেই চলে।

পাখির খাঁচায় ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। রঙিন পালকের ছড়াছড়ি, নানারকম ডাক, ডানার ঝাপটানি-সব মিলিয়ে এক অপার্থিব পরিবেশ। ময়ূর, রাজধনেশ, ম্যাকাও-সব যেন গল্পের চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু বড়ই মায়া হলো। যাদের আকাশে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা তারা আজ লোহার খাচায় বন্দি। শুধুমাত্র আমাদের বিনোদনের মাধ্যম হতে।

আমাদের সফরসঙ্গী হানিফ মালয়েশিয়া থেকে এসেছে পড়তে। চিড়িয়াখানার প্রাণিবৈচিত্র্য দেখে সে চমকে উঠেছিল। “ইট ইজ সো র’! সো ন্যাচারাল!”- বলল সে। আমরা বুঝলাম, আমাদের দেশে যা স্বাভাবিক, তা অন্যের চোখে কত অনন্য। বাংলাদেশ শুধু কৃষিপ্রধান দেশ নয়, প্রাণিবৈচিত্র্যেরও ভাণ্ডার। হানিফের বিস্ময় যেন আমাদেরকেও নতুনভাবে দেখালো পরিচিত দৃশ্যগুলোকে।

চিড়িয়াখানা শুধুই পশু-পাখি দেখার জায়গা নয়। আমাদের মতো ভেটেরিনারি শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি উন্মুক্ত ল্যাবরেটরি। প্রতিটি প্রাণি একটি পাঠ্যপুস্তক, প্রতিটি খাঁচা একটি অধ্যায়। প্রাণিদের খাদ্যাভ্যাস, আচরণ, রোগের উপসর্গ, বাসস্থান-সবই যেন জীবন্ত রূপে উপস্থাপিত হলো আমাদের সামনে। তত্ত্ব আর বাস্তবের মাঝে এমন মিল খুব কমই দেখা যায়।

দুপুর দেড়টায় খাওয়া দাওয়া করার পরেই বুঝে গিয়েছিলাম চিড়িয়াখানায় আর বেশি সময় আমরা থাকছি না। তবে পুরো গ্রুপ-এইচ একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া করাটাও ছিলো মনে রাখার মতো। এমন ট্যুর ছাড়া সবার একসাথে বসে খাওয়া বলতে গেলে অসম্ভব।

বিকেলে সাড়ে তিনটার দিকে আমরা ধীরে ধীরে ফিরছিলাম চিড়িয়াখানার ফটকের দিকে। কিন্তু মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ফেলে যাচ্ছি। সেটা হয়তো সিংহের চোখ, বানরের ব্যঙ্গ, কিংবা হরিণের সরলতা বা হয়তো নিজের ভেতরের এক নতুন উপলব্ধি।

হানিফ ফিরে যাওয়ার সময় বলল, “আই উইল টেল মাই ফ্যামিলি অ্যাবাউট ইট।” আমরা তাকিয়ে ছিলাম তার চোখের দিকে-সেখানে ছিল কৃতজ্ঞতা, মুগ্ধতা আর বন্ধুত্বের ছায়া।

সেদিন মিরপুর চিড়িয়াখানার সেই সফর কেবল ভ্রমণ ছিল না। সেটা ছিল শিখনের, উপলব্ধির, ভালোবাসার এবং সবচেয়ে বড় কথা-মানুষ হয়ে ওঠার এক নিরব অভিপ্রায়। পশু-পাখির চোখে চোখ রাখলে অনেক সময় মানুষ নিজের মুখ দেখতেও শেখে। আমাদের সেই এক বিকেল শেখাল-প্রাণ ভালোবাসা মানেই নিজেকে ভালোবাসা।

সফরের ফাঁকে ফাঁকে আমরা নিজেদের ভেতরেও খুঁজে পেয়েছিলাম নতুন কিছু। ক্লাসে বসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসা যতটা না বন্ধুত্ব, তারচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে একসাথে হাঁটলে, একই দৃশ্য দেখে একসাথে চুপ থাকলে। সোহান বলল, “ভাই, এই সফর শুধু প্রাণির না, মানুষের সফরও ছিল।” আমরা বুঝতে পারলাম-বন্ধুত্বের জোর আসলে অনুভবেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে