বাংলাদেশের উন্নয়ন খাতে বৈদেশিক সহায়তা হ্রাসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা কার্যক্রম এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী দাতাদের উৎসাহে ঘাটতি, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংকটে মনোযোগ এবং সাহায্য নীতির পরিবর্তনের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে এখন টেকসই পদ্ধতি ও বিকল্প অর্থায়নের পথ খুঁজে বের করা জরুরি।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) রাজধানীর মহাখালিতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এই আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা। ‘উন্নয়ন তহবিল খাতের পট পরিবর্তনে কমিউনিটি সহায়তা জোরদারকরণ’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে একশনএইড বাংলাদেশ।
এতে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, বেসরকারি খাতের কর্মকর্তা, জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, নীতি বিশ্লেষক, গণমাধ্যমকর্মীসহ উন্নয়ন খাতের গবেষকরা অংশ নেন। আলোচনায় বক্তারা তহবিল কমে যাওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্ভাব্য প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা পেলেও, এই সহায়তা ধারাবাহিকভাবে কমছে। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, গত বছর দেশের কাজ করা এনজিওগুলো ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা পেয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৬ শতাংশ কম। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর সহায়তা নীতিতে আকষ্মিক গতিপথ পরিবর্তনের কারণে বিপুল পরিমান অর্থ সহায়তা স্থগিতের সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প বন্ধ ও স্থগিত হয়ে গেছে। উন্নয়ন সাহায্যের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। এছাড়াও বাণিজ্য শুল্ক বৃদ্ধি এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক অস্থিরতার মতো সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা এবং বেসরকারি খাতের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিলসহ সহনশীল ও টেকসই পন্থায় মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, "স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলোর ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। তাই আমাদের দক্ষিণ-দক্ষিণের তহবিল অনুসন্ধান করতে হবে, একটি জাতীয় সিএসআর ফ্রেমওয়ার্ক গ্রহণ করতে হবে (যা অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতে পারে), বেসরকারি খাতের সমর্থন বাড়াতে হবে, সরকার ও নাগরিক সমাজ উভয় ক্ষেত্রে ডিজিটাল ও কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে, গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে এবং মানবাধিকার-ভিত্তিক সামাজিক উন্নয়নের জন্য ১০০০ কোটি টাকার একটি নির্দিষ্ট বাজেট রাখার পক্ষে কথা বলতে হবে।”
এই সংকট মোকাবিলায় সকলকে একযোগে কাজ করা এবং উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানান একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। তিনি বলেন, “বর্তমান তহবিল সংকট গ্রাম ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষা পরিষেবা প্রদান ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে নারী, শিশু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর গভীর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদি এর সমাধান না করা হয়, তবে এটি গভীর সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন প্রচেষ্টার ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে। কমিউনিটি উন্নয়ন প্রচেষ্টাগুলোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সক্রিয় এবং সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।”
এলডিসি উত্তরণের বাস্তবতায় সিভিল সোসাইটি সংস্থাগুলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে অবদান রাখতে হলে দূরদর্শী ও কৌশলগত রূপান্তর এখন সময়ের দাবি উল্লেখ করেন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান। তিনি বলেন, “আমাদের প্রকৃতিনির্ভর সমাধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও কৃষি প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একইসঙ্গে, সিভিল সোসাইটি ও স্থানীয় কমিউনিটিকে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে। যাকাত তহবিলকে সরকারের তত্ত্বাবধানে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যবহারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তরুণদের সম্পদ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা এবং তথ্য-ভিত্তিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয় সম্পদ সংরক্ষণে একটি সুশাসন কাঠামো গড়ে তোলাও গুরুত্বপূর্ণ।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন নিলোর্মি জানান, বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) মর্যাদা থেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় শুধু পরিকল্পনার উপর নির্ভর না করে তার বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে। তিনি বলেন, “কর ছাড়ের বিষয়ে আরও কঠোর নজরদারি করতে হবে এবং বেসরকারি খাতের কর সুবিধাগুলোকে তৃণমূল পর্যায়ের সিএসও (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন) সংগঠনগুলোর জন্য বিনিয়োগে রূপান্তর করতে হবে। নীতিগত চাপ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে, স্থানীয় সিএসওদের নতুন প্রযুক্তি ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।”
এএআইবিএস-এর বোর্ড চেয়ারপার্সন ইব্রাহিম খলিল আল-জায়াদের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গোলটেবিল আলোচনা শেষ হয়। এসময় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন এনজিও ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গবেষক, শিক্ষাবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তারা তহবিল সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।