শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভোজ্যতেল উৎপাদন বাড়াতে পারে পেরিলা

কৃষিবিদ সৌমিক দেব
  ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

পেরিলা বাংলাদেশে অভিযোজিত একটি নতুন ভোজ্যতেল ফসল। সম্ভাবনাময় ফসল পেরিলা চাষ করে বেশ ভালো লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এটি চাষ করে দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদাও অনেকাংশ কমানো সম্ভব। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) নামে বাংলাদেশে প্রথম এর একটি জাত নিবন্ধিত হয়। জাতটি এখন মাঠ পর্যায়ে চাষ চলছে।

বাংলাদেশে উচ্চফলনশীল ও পুষ্টি সমৃদ্ধ আবহাওয়ায় অভিযোজন সম্পন্ন নতুন এক তেলজাত ফসলের নাম পেরিলা। মূলত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তথা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনামসহ ভারতের কিছু অঞ্চলে এর চাষ হয়। পেরিলা মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার জাত- যা কোরিয়ান পেরিলা নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম চবৎরষষধ ভৎঁঃবংপবহং (খ.) ইৎরঃঃড়হ এবং এটি খধসরধপবধব (গরহঃ) পরিবারভুক্ত। পেরিলা একটি ভোজ্যতেল ফসল যার শতকরা ৬৫ ভাগই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ। এর তেল আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী। বিশেষ করে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগে এটি কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

এটি এখন বাংলাদেশের মাটিতে যে কেউ চাষ করতে পারেন। তবে চাষের আগে কয়েকটি বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। পানি জমে থাকে না এমন প্রায় সব ধরনের মাটিতে এ ফসল চাষের উপযোগী। তবে বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটি পেরিলা চাষের জন্য বেশি ভালো। খরিপ-২ মৌসুম, বীজবপনের উপযুক্ত সময় ১০ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই। পেরিলা অত্যন্ত ফটোসেনসেটিভ ফসল। সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পেরিলা গাছে ফুল আসা শুরু হয়। কাজেই গাছের পর্যাপ্ত অঙ্গজ বৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ফলন পেতে হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই বীজবপন করতে হবে। প্রতি হেক্টরে এক থেকে দেড় কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজতলার প্রস্থ এক থেকে দেড় মিটার হবে। দৈর্ঘ্য জমির আকার অনুযায়ী যে কোনো মাপে নেওয়া যাবে। বীজতলায় জৈবসারের ব্যবস্থা করলে স্বাস্থ্যবান চারা পাওয়া যাবে।

বীজতলায় দুই বেডের মাঝে নালার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে বৃষ্টি হওয়ার পর অতিরিক্ত পানি বীজতলায় জমে না থাকে। বীজের আকার ছোট হওয়ায় মাটি যথাসম্ভব ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। পিঁপড়ার আক্রমণ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খরিপ-২ মৌসুমে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় বীজবপনের পর প্রথম ১৫ দিন পর্যন্ত বীজতলার চার পাশে খুঁটি দিয়ে উঁচু করে পলিথিন দেওয়া যেতে পারে। ১/৪ ইঞ্চি গভীর লাইন করে বীজবপন করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। অথবা বীজ ছিটিয়ে দিয়ে ঝুরঝুরে মাটি উপরে দিয়ে দিতে হবে। বীজবপনের পর বীজতলায় হালকা করে পানি দিতে হবে। বীজতলা যেন একেবারে শুকিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।

বীজে পরিপক্বতা আসার পর গাছের গোড়া কেটে দিতে হয় অথবা পুরো গাছ উপড়ে ফেলতে হয়। তারপর শক্ত চটের বস্তা অথবা শক্ত পলিথিন বা ত্রিপল বিছিয়ে গাছগুলো ধরে হালকাভাবে পিটিয়ে বীজ সহজেই সংগ্রহ করা যায়। হেক্টরে এক দশমিক তিন থেকে এক দশমিক পাঁচ টন ফলন হয়ে থাকে।

বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজের আর্দ্রতা সাত থেকে আট শতাংশ হলে বীজ টিন অথবা পস্ন্যাস্টিকের পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ সংরক্ষণের পাত্রে বাতাস যেন চলাচল না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংরক্ষিত বীজ যথাসম্ভব আর্দ্র নয় এমন ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। সংরক্ষণের জন্য বীজভর্তি পাত্র মাটির সংস্পর্শে রাখা বাঞ্ছনীয়।

গোল্ডেন পেরিলার তেল মানবদেহের জন্য উপকারী। দেশে দিন দিন বাড়ছে ভোজ্যতেলের চাহিদা। প্রয়োজনের তুলনায় উৎপাদন কম হওয়াতে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। পেরিলা চাষের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটানো যাবে। শুধু ভোজ্যতেল নয়, পেরিলার ফুল থেকে মধু আহরণ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব বলেও মনে করেন কৃষিবিদরা। পেরিলা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তথা দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে চাষ হয়ে থাকে। উচ্চগুণাগুণ সম্পন্ন ও উচ্চমূল্যের একটি ভোজ্যতেল ফসল পেরিলা। এটি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। চোখের জন্যও বেশ উপকারী। এর ফ্যাটি এসিড শরীরের জন্যও উপকারী। পেরিলা বাংলাদেশে অভিযোজিত একটি নতুন ভোজ্যতেল ফসল। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) নামে বাংলাদেশে প্রথম পেরিলার একটি জাত নিবন্ধিত হয়।

বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ ধান চাষ হয়। আউশ ধান কর্তন করার পর এর বেশির ভাগ জমি প্রায় আড়াই মাস পতিত থাকে। এরপর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সরিষা বপন করা শুরু হয়। মূল জমিতে পেরিলার জীবনকাল মাত্র ৭০-৭৫ দিন হওয়ায় সহজেই এর বেশিরভাগ জমিতে সরিষা বপনের পূর্বে পেরিলা রোপণ করে কর্তন করা যায়। লবণ সহনশীল হওয়ায় উপকূলীয় বন্যামুক্ত পতিত জমি সহজেই পেরিলার আওতায় আনা সম্ভব। এ ছাড়া আমন ধান হয় এমন উঁচু জমি যেখানে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হয় এবং খরচ অপেক্ষাকৃত বেশি সেসব জমি পেরিলার আওতায় নিয়ে এলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমন ধান রোপণ করার পর পতিত বীজতলাসমূহ পেরিলা চাষের আওতায় আনলে দেশে তেল ফসলের ঘাটতি কিছুটা পূরণ করা সম্ভব হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে