শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গণমাধ্যমের জন্য চাই অলঙ্ঘনীয় স্বাধীনতা

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ০৮ জুন ২০২১, ০০:০০

আজকের সভ্যতাকে একটি ইমারতের সঙ্গে তুলনা করা হলে গণমাধ্যমগুলোকে এ ইমারতের এক একটি স্তম্ভ বলা যায়। সংবাদপত্র হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার প্রাণ। এটি সমাজের সামগ্রিক পরিচয়ের প্রাত্যহিক দলিল। সমাজের অসঙ্গতি দূর করার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র এবং সমাজ বিনির্মাণে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ভূমিকা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা থেকে শুরু করে বিদ্রোহ, বিপস্নব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র সব কিছুই এর আওতায়।

শিক্ষা, খেলাধুলা, আইন-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, খুন-জখম, চুরি-ডাকাতি, আমোদ-প্রমোদ, শেয়ার মার্কেট, বাজার দর, কর্মখালি, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি সবকিছু আমাদের সামনে উপস্থিত করে। সংবাদপত্র আমাদের অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার সুযোগ করে দেয়। এই সংবাদপত্র অবশ্যই স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং বাস্তবধর্মী হতে হবে। সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে আমরা কি বুঝি? সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, সকল প্রকার প্রভাব মুক্ত হয়ে প্রকৃত বা সত্য সংবাদ পরিবেশনের ক্ষমতা। স্বাধীন সংবাদপত্র নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করে জাতিকে সত্য, সুন্দর ও সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারে। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা ভেবে সঠিক সংবাদ পরিবেশন করা একান্ত প্রয়োজন। আবার ভুল সংবাদ, মিথ্যে সংবাদ বা বিকৃত সংবাদ জাতীয় জীবনে অশান্তি ও পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে। তাই সংবাদপত্রকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হলে এগুলো অবশ্যই পরিহার করতে হবে। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে। স্বাধীন সংবাদপত্রের অস্তিত্ব ছাড়া একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন জাতির অস্তিত্ব কল্পনা করা কষ্টকর। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে তাই প্রতিটি উন্নত ও স্বাধীন দেশেই অলঙ্ঘনীয় বিধান বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। ৩ মে 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে' বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের এক সভায় ১৯৯৩ সালে এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই দিবসটিতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, ত্যাগী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হয়। ২০০২ সাল থেকে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স বিশ্বের ১৮০টি দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে তার ভিত্তিতে মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করে থাকে। সম্প্রতি রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) এই সূচক প্রকাশ করে। এতে ১৮০টি দেশের মধ্যে এই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় আরও একধাপ পিছিয়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র এবং আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে যা মৌলিক অধিকার হিসেবে আমাদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন সংবাদ মাধ্যম নিয়ে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন 'সবার সব নিরাপত্তা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নিহিত'। আইনের শাসন, গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এ বিষয়গুলো একটি অপরটির পরিপূরক। গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত।

সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) আর্টিকেল-১৯ এর অধীনে একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আওতায় সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে স্বীকৃত। গত ১৭ মে একজন নারী সাংবাদিক সচিবালয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন এবং উল্টো তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। এখানে টেনে আনা হয়েছে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের প্রসঙ্গ। অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট মূলত একটি ঔপনিবেশিক আইন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই আইন-প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৮৯৯ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন যখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন তখন এই আইন প্রণয়ন করা হয়। বেশ কয়েক দফা সংশোধিত হয়ে ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট জারি করা হয়। মূলত এই আইনটি তৈরি করে সত্যকে আড়ালে রাখার জন্য। এর সঙ্গে সঙ্গে ওথ অব সিক্রেসি, গভর্নমেন্ট রুলস অব বিজনেস এবং কনটেম্পট অব কোর্ট আইনগুলো অবাধ তথ্যপ্রবাহের পথে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অন্যদিকে গণতন্ত্র তথ্য অধিকার নিশ্চিত করে, যা জনগণকে শক্তশালী করে। গণতন্ত্রে অবাধ তথ্যপ্রবাহ আইনের দ্বারা একটা অধিকার নিশ্চিত করে। মতপ্রকাশের অধিকার যে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার। যদি কোনো তথ্য জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হয় সে ক্ষেত্রে তা প্রকাশে বাধা রয়েছে। সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্নীতি ও অসঙ্গতির তথ্য প্রবাহ তুলে ধরেন। একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয়, অন্যদিকে সচেতন থাকতে হয় পাঠকের অনুসন্ধিৎসা সম্পর্কে। সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র হচ্ছে গোপনীয়তার শত্রম্ন। যেখানেই সমাজবিরোধী দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্বেষী অশুভচক্রের ষড়যন্ত্র, সেখানেই সাংবাদিক তৎপর হন জানমালকে বাজি রেখে। কারণ গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব কোনো দুর্নীতি, অনিয়ম ও গণবিরোধী কিছু ঘটলে জনগণের সামনে তা উন্মোচন করা। যদি অবাধ তথ্যপ্রবাহ থাকে কোথাও, সেই সমাজে স্বচ্ছতা থাকবে। যদি জনগণের মধ্যে তথ্যের অবাধ চলাচল থাকে, তারা লড়তে পারবেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও খারাপ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে। তথ্যসংগ্রহ করতে না পারলে প্রতিবেদন কীভাবে তৈরি করবেন। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য সংগ্রহের এবং প্রচারের অধিকার সাংবাদিকদের রয়েছে। কাজেই এটা অবধারিত সত্য, অবাধ তথ্যের প্রবাহ সত্যিকারভাবেই জনগণকে শক্তিশালী করে এবং জনগণ সেই শক্তির দ্বারা সমাজকে সুন্দর ও স্বচ্ছ রাখতে পারে। যে সমাজে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিদ্যমান, গণমাধ্যম মুক্ত ও স্বাধীন সে সমাজই আলোকিত। যে কোনো জাতি তথা সমাজের উন্নতির ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা।

বস্তুনিষ্ঠ, সত্য সংবাদ জাতীয় স্বার্থে প্রকাশ করার অধিকার অলঙ্ঘনীয় হওয়া চাই। মনে রাখতে হবে, স্বাধীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ন্যায়নিষ্ঠ সমালোচনার মধ্যদিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের দোষ-ত্রম্নটি সংশোধনের পথ যেমন দেখাতে পারে, তেমনি তা জাতীয় উন্নতির জন্য যুক্তিসঙ্গত সুপারিশও রাখতে পারে।

লেখক: আইনজীবী

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে