বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ভালো আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

অ্যাডভোকেট এম মাহমুদুল হাসান
  ২২ জুন ২০২১, ০০:০০
ভালো আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

লেখাটা আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য, যারা স্বপ্ন দেখে একজন ভালো আইনজীবী হয়ে মানুষের সেবা করার। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের সামনের দিকের তালিকায় 'আইন' অন্যতম। আইন বিভাগে যারা ভর্তি হন তাদের অধিকাংশের মাথায় থাকে ভবিষ্যতে আইনকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার, সেটা হতে পারে বিচারক কিংবা আইনজীবী হওয়া (সবার ক্ষেত্রে সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু আইন বিভাগে ভর্তির সময় এটা আমার মাথায় ছিল)।

যদিও পরে অনেকেই আর আইন পেশায় আসেন না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশাসন কিংবা অন্য চাকরিকে বেছে নেন। কিছু সৌভাগ্যবান বিচারক হয়ে হাব-ভাবের নিশ্চিন্ত জীবন বেছে নেন। আর সবশেষ কেউ কেউ সাহস করে আইনপেশাকে বেছে নেন (কিংবা বেগতিক হয়ে আসেন!)। 

বিচারক কিংবা অন্যান্য চাকরি জীবনের শুরুটা যেমন হাব-ভাব এবং অর্থনৈতিক নিশ্চিন্ততাসহকারে হয়, আইনপেশা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে এসে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তুখোড় মেধাবীও নিজেকে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করবে। সে দেখবে এ পেশার কোনো কিছুই সে আগে থেকে শিখে আসেনি!

বিষয়টা অদ্ভুত মনে হলেও এটাই সত্যি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও মাঝেমধ্যে বিষয়টা বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। বলেন একাডেমিক এবং প্রাকটিস সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। কিন্তু আলাদা নামক অদ্ভুত জিনিসটা সামনে আসার আগ পর্যন্ত আমরা জানি না, কিংবা আমাদের জানানো হয় না, কিংবা যারা জানাবেন তারা নিজেরাই জানেন না। এটাই আমাদের লিগ্যাল এডুকেশনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এটা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করব ইনশালস্নাহ।

দ্বিতীয়ত, এখানে মোটামুটি সবাই জ্ঞান দেবে এটা গুরুবিদ্যা, সিনিয়রের সঙ্গে থেকে দেখে দেখে শিখতে হয় (এটাই সত্য) তাতে দেখে দেখে হাতুড়ে ডাক্তারের মতো হাতুড়ে আইনজীবী হওয়ার চান্সও বেশি, যদিও অনেকে পরবর্তীতে নিজ প্রচেষ্টায় নিজেকে বিশেষজ্ঞের পর্যায়ে নিয়ে যান।

তৃতীয়ত, এখানে ভালো একজন সিনিয়র পাওয়া যেন সোনার হরিণ। অধিকাংশ সিনিয়র বিশ্বাস করেন জুনিয়রদের টাকা দেওয়া উচিত না (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে), কিংবা নামমাত্র কিছু সদকা দেবে যা দিয়ে হয়তো আসা-যাওয়ার ভাড়াটা হতে পারে, কিন্তু চলার জন্য এটা কোনোভাবেই যথেষ্ট না (জজ কোর্টের ক্ষেত্রে এটা বেশি সত্য, আমি এমনও দেখেছি সিনিয়র জুনিয়রকে বলে দিয়েছেন 'তুমি থাকতে পারো, কিন্তু আমি তোমাকে কোনো টাকা দেবো না।' কেউ কেউ দৈনিক ১০০ টাকা দেন।), তাই কোর্টে এসেই মামলা পাওয়ার ফিকির করতে হয়, যা প্রাকটিসের বারোটা বাজাতে যথেষ্ট! 

সিনিয়রকেন্দ্রিক আরেকটা বড় সমস্যা হলো- মনের মতো সিনিয়র না পাওয়া। এখানে ভালো সিনিয়রের পরিমাণ অনেক কম। আপনি হয়তো এমন সিনিয়র পেলেন যিনি শুধু ক্রিমিনাল মামলা করেন, কিংবা শুধু সিভিল মামলা করেন, তাতে আপনার শেখাটাও পার্শিয়াল হবে। আবার সিনিয়র হয়তো পেলেন কিন্তু এমন কিছু সিনিয়র আছেন যারা জুনিয়রদের শেখাতে চান না। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট মামলা রিসিভ করা পছন্দ করেন না।

সিনিয়রকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে হয়তো এমন হাজারো অদ্ভুত/নির্মম কাহিনি শোনা যাবে। তবে এমনও অনেক সিনিয়র আছেন যারা জুনিয়রদের সন্তানের মতো আদর করে শেখান, বটবৃক্ষের মতো ছায়ায় আগলে রাখেন। এ পেশায় এটাই বাস্তবতা যে এখানে সিনিয়ররা বেঁচে থাকে জুনিয়রদের মাধ্যমে। আপনি কার জুনিয়র কোর্টে এটা ম্যাটার করে। 

চতুর্থত- আইনজীবীকে অনেক বিষয়ে এক্সপার্ট হতে হয় (ধীরে ধীরে)। যেমন- ক্লায়েন্ট কনফারেন্সিং, লিগ্যাল রিসার্চ, ড্রাফটিং, কোর্টে সাবমিশন, সাক্ষী নেওয়া, জেরা করা, রিটেন আর্গুমেন্ট রেডি করা ইত্যাদি। হতাশার বিষয় এই যে উলিস্নখিত বিষয়গুলোর কোনোটাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেভাবে শেখানো হয় না। যার কারণে দীর্ঘ সময় ভোগান্তি পোহাতে হয়। তবে সঠিক নির্দেশনা পেলে এবং চেষ্টা-প্রচেষ্টায় তা দূর হয়ে যায়। এভাবে হরেক রকমের চড়াই-উতরাই পার হয়ে এ পেশার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে কিছুটা স্থিতি আসতে ৩-৫ বছর সময় লেগে যায়। তবে শর্ত হলো- নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজে লেগে থাকতে হবে এবং প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করা আবশ্যক। তবে কেউ কেউ বলেন এ পেশার শুরুটা এত বেশি চ্যালেঞ্জিং হওয়ার সুবিধা হলো অতি মেধাবী বা শর্ট-কাট রাস্তা খোঁজারা হারিয়ে যায় এবং মোটামুটি মেধাবীরা টিকে যায়, যদিও সব ক্ষেত্রে কথাটা সঠিক নয়। 

এতগুলো ভয় জাগানো চ্যালেঞ্জের কথা শুনে নিশ্চয়ই আমার প্রিয় অনুজরা ভয় পাচ্ছে। আচ্ছা এখন এ পেশার কিছু সম্ভাবনার দিক তুলে ধরব। তোমরা নিশ্চয়ই জানো পৃথিবী কাঁপানো অধিকাংশ রাজনীতিবিদরা আইনে পড়াশোনা করা মানুষ। সেটা বারাক ওবামা হোক আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হোক। কোর্ট আঙ্গিনায় (বিশেষত সুপ্রিম কোর্টে) প্রতিনিয়ত তোমার সঙ্গে দেখা হবে এমন আইনজীবীদের যারা বড় বড় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন, যেমন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, এমপিসহ অনেকের সঙ্গে যা তোমার আত্মবিশ্বাসকে তুঙ্গে নিয়ে যাবে।

আইনপেশার সবচেয়ে উত্তম দিক হচ্ছে এখানে তোমার বিচরণ ক্ষেত্র বিশাল। তুমি তোমার মেধার সবটাকে এখানে কাজে লাগাতে পারবা। তুমি স্বাধীনভাবে জীবন পরিচালনা করতে পারবা। তুমি মানুষের জন্য কাজ করতে পারবা। আমাদের মূল অধিক্ষেত্র যেহেতু আইনপেশা তাই তোমার বন্ধুরা যে পেশায়ই থাকুক না কেন আইন পেশায় কেন এলো না এ আফসোস তাদের থাকবেই।

তুমি ভালো আইনজীবী হলে হালালভাবে অনেক ইনকাম করতে পারবা। গাড়ি-বাড়ি করার জন্য দুর্নীতি করতে হবে না। শুনতে অবাক লাগলেও আমি এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। এটা তো

সত্য, পেশায় প্রাপ্তি সর্বোচ্চ তাতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম তো থাকবেই। আমার সিনিয়র একটা কথা প্রায়ই বলেন, এ পেশায় সাফল্যের প্রথম শর্ত হলো লেগে থাকা, শেখার মানসিকতা বজায় রাখা, ওহয়ঁরংরঃরাব মন থাকা, সর্বোপরি ডানে বামে না তাকিয়ে কাজ করে যাওয়া, প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। 

লেখক- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে