পরপারে চলে গেলেন আবুবকর সিদ্দিক, বাংলা সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি সমভাবে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কবিতা ও কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে যেভাবে তার সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন তা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। অত্যন্ত নিভৃতচারী প্রচার বিমুখ এই লেখক সাহিত্যকে ধারণ করেছেন অস্থিমজ্জায়। লেখালেখিই যেন তার ধ্যান-জ্ঞান সাধনা। জীবনের নানা বৈরী স্রোতের মধ্যেও লেখালেখিতে বিরতি টানেননি তিনি। এ দেশে হাতেগোনা যে ক'জন কবি নির্মেদ আবেগহীন প্রাঞ্জল ভাষায় কথাসাহিত্যের চর্চা করেছেন, তাদের মধ্যে তিনি একজন। তার গল্প উপন্যাস পড়লে বোঝাই যায় না, কোনো কবির লেখা। ফলে বাংলা কথাসাহিত্যে ঈর্ষণীয়ভাবে তিনি শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তার লেখায় উঠে এসেছে মানুষের ভেতরের মানুষ, বাস্তবতার ভেতরের বাস্তবতা। বিশেষ করে তার উপন্যাস জলরাক্ষস, খরাদাহ এবং একাত্তরের হৃদয়ভস্ম তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যে প্রাণপ্রবাহের সৃষ্টি করেছেন, পাঠককে যেভাবে যেমাত্রায় চিন্তাচেতনার গভীরে নিয়ে গিয়েছেন তা আমরা খুব কম কথাসাহিত্যিকের মধ্যেই পাই। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার যে দরদ ও দক্ষতা তা একজন সফল ও পরিশ্রমী শিল্পীরই প্রকৃত রূপ।
জীবন সমীক্ষা ও জীবন রূপায়ণের ক্ষেত্রে তার যে দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা তা অনবদ্য স্বতন্ত্র। সমাজনিষ্ঠ জীবনঘনিষ্ঠ এই শিল্পী বস্তুবাদী মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন সাহিত্য রচনায়। তিনি প্রান্তিক শোষিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে তার সাহিত্যে অত্যন্ত শিল্পসফলভাবে তুলে এনেছেন। গ্রামীণ জীবন, নদী-প্রকৃতি বিস্তীর্ণ খরাপ্রবণ ফসলের মাঠ, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী উন্মূল মানুষের অস্তিত্ব সংকট, জীবন যন্ত্রণা ও অন্তঃসারশূন্যতা তার গল্প উপন্যাসের উপজীব্য। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মানুষের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না ব্যথা-দুঃখ কারতা এবং অস্তিত্ব সংকটকে তিনি রূপ দিয়েছেন অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে, সফলতার সঙ্গে। তার যে নিরীক্ষাধর্মী গদ্যরীতি এবং চরিত্র সৃষ্টির দায়বোধ এটা তার সমসাময়িক খুব কম লেখকের গল্প উপন্যাসেই চোখে পড়ে। সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার শিল্পসাফল্যে উত্তীর্ণ তার গল্প-উপন্যাসগুলো। কখনো কখনো মনে হয় তিনি কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্যে বেশি সফল। যদিও ষাটের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণসঙ্গীত রচনা করে কেবল আলোড়ন সৃষ্টিই করেননি, জাগরণও ঘটিয়েছিলেন। এমনকি সিগারেটের প্যাকেটেও তিনি গণসঙ্গীত লিখে বিপস্নবীদের কাছে পাঠিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন এক আবুবকর সিদ্দিককে প্রত্যক্ষ করি।
ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যের শুভ সূচনা ঘটলেও তার উপন্যাস জলরাক্ষস ও খরাদাহ তাকে সাহিত্যিকখ্যাতি এনে দেয়। তার খরাদাহ উপন্যাস এক অনবদ্য সৃষ্টি। এ উপন্যাসে রসহীন মাটি, নিষ্ঠুর প্রকৃতি আর সংগ্রামী প্রতিবাদী মানুষেরই জীবনালেখ্য।
খরাদাহ উপন্যাসের প্রতিপাদ্য দুর্ভিক্ষ ও খরাপোড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের জনজীবন। এ উপন্যাসে তিনি আঞ্চলিক শব্দের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন বিভিন্ন চরিত্রের জবানিতে, তুলে এনেছেন নিরেট সত্যকে বাস্তবতাকে। খরাপ্রবণ চৌচির ভূমি এবং খাদ্যের জন্য হাহাকার ও সংগ্রাম এই উপন্যাসে একাকার হয়ে গেছে।
একদিকে মাটির প্রাণরস তথা উর্বরতা কেড়ে নেয়া গ্রীষ্মের নিষ্ঠুর সূর্য, অন্যদিকে, শহরের পুঁজি মালিক ও গ্রামের জোতদারদের অমানবিক অন্যায় ও শোষণ। এর বিপরীতে লাঠিয়ালদের গণবিদ্রোহ। সে এক বিস্ময়কর অবিস্মরণীয় চিত্র, কখনো প্রতীকরূপে কখনো বা রূপকের সাহায্যে বর্ণিত হয়েছে নিখুঁত কারুকার্যময় ভাষায়। এ উপন্যাসের ভাষা ও চরিত্র যেন ক্যামেরার কাজ। উপন্যাসের শুরু এভাবে 'দুজেলা পার হয়ে গেছে। তৃতীয় জেলার প্রথম স্টেশন এটা। পস্ন্যাটফর্মে পা নামাতেই হঠাৎ করে আগুনগলা বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ কেউ কপাল চেপে ধরে ঠ্যাকা দেওয়ার ভঙ্গি করে। বুঝি জামাতেই আগুন ধরে গেছে। বাতাস জামার ফাঁক গলে বুকের চামড়া ঝলসে দিয়ে গেল।'
তার উপমা প্রতীক ও শব্দ ব্যবহারের আরো উজ্জ্বল কিছু বাক্য 'নিঃশ্বাসে ঠোঁটের পাতা পুড়ে যায়। একটানা শূন্যতার চেহারা দেখতে দেখতে চোখের মণি করকর করে ওঠে। ভাজা বাদামি ঘাস মুড় মুড় করে ভাঙতে থাকে। দু'পায়ের মোজায় শাদা ধোলার বার্নিশ। মাঠের মধ্যে আলছাড়া পথ নেই। ফাটল ছাড়া মাটি নেই' ইত্যাদি।
আর এখানেই আলোচ্য উপন্যাসের সার্থকতা। অন্যদিকে, দক্ষিণ বাংলার, বিশেষ করে খুলনা-বাগেরহাটের প্রান্তিক মানুষকে পুঁজি করে এবং ওই এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশকে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে জলরাক্ষসের কাহিনী। এই উপন্যাসে প্রকৃতি ও জীবন ধরা দিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজে ও আচরণে। বিরুদ্ধ শক্তিকে মোকাবিলা করতে প্রতিবাদী মানুষের যে আমরণ সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই এবং অস্তিত্ব রক্ষার প্রচেষ্টা এই উপন্যাসে তা সফলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
একাত্তরের হৃদয়ভস্ম উপন্যাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে এবং যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিকে যেভাবে যে ভাষায় রূপায়ণ করেছেন তা পাঠকের চেতনার জগতে নতুনভাবে নাড়া দেয়, সাড়া দেয় এবং নতুন ভাবনার উদ্রেক করে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যে আজো অসম্পূর্ণ এবং বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যিনি মুক্তিযোদ্ধা নন তিনি অর্থ, ক্ষমতা আর পেশিশক্তির দাপটে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যাচ্ছেন, আর আড়ালে পড়ে অভাব-হাহাকারের মধ্যে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। মূলত একাত্তরের মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করার সফল প্রয়াস এটা। উপন্যাসের নায়ক সুশান্ত ভট্টাচার্য গ্রামীণ জনপদে মাঠপর্যায়ে রিপোর্ট করতে না গেলে এই সত্য ধরা পড়ত না। অত্যন্ত কৌতূহলী মন নিয়ে এই তরুণ সাংবাদিক যেমন গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের জন্য গিয়েছেন, তেমনি নানা বিস্ময়কর ও বিপরীতধর্মী ঘটনার পরম্পরায় তার হৃদয় ক্ষরিত হয়েছে।
একে একে উন্মোচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায়। ভ্যানচালক বোচা মিয়া এবং অধ্যাপক নীতিশের জবানিতে তিনি যা শুনতে পান এবং প্রত্যক্ষ করেন, তাতে তার চেতনার জগৎ খুলে যায়। বিবেকতাড়িত এই তরুণ সাংবাদিক হোঁচট খান বারবার। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যারা বিকৃত, ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের শোষণ-নির্যাতনের কাতারে দাঁড় করিয়েছে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে এই উপন্যাসে। ভদ্রকাঠির তরুণরা জেগেছে। গ্রামীণ সামন্ত শোষকদের পকেটে যে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্ব চলে গিয়েছিল, তা আবার ফেরত আসতে শুরু করে। এই উপন্যাসেও ভাষার গতিময়তা, চরিত্রের গভীরতা এবং প্রাঞ্জলতা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
প্রকৃত অর্থে তার আলোচ্য তিনটি উপন্যাসই বাংলা কথাসাহিত্যে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। আঞ্চলিক সংলাপের মিশেলে কখনো বা মূল চরিত্রের জবানিতে ঔপন্যাসিকের গল্প বলার কৌশল ও ক্ষমতা অদ্ভুত। এর পাশাপাশি ভাষার জাদুকরি আবহ ও আকর্ষণ তো আছেই। এ দেশের তথাকথিত ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের সঙ্গে এর তুলনা চলে না।
জীবনকে ছেনে ছুঁয়ে মন্থন ও মূল্যায়ন করে নতুনভাবে রূপায়ণ করেছেন তিনি তার তিনটি উপন্যাসেই। ফলে এসব উপন্যাস পাঠে কেবল পাঠকের চেতনা জগতেই নাড়া দেয় না, সাড়া তোলে না; জীবন উপলব্ধির ধরনও বদলে দেয়। এই যে সাড়া ফেলা বা নাড়া দেয়া কিংবা বদল ঘটানো এটা কোনো শক্তিমান ঔপন্যাসিক ছাড়া সম্ভব নয়। এ যেন কেবল কোনো ঘটনার বা চরিত্রের পোস্টমর্টেম নয়, জীবনেরই পোস্টমর্টেম।
জীবনকে দেখার এবং মূল্যায়ন করার দৃষ্টিভঙ্গি যেহেতু তার ভিন্ন, সম্ভবত সে কারণেই তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলোর প্রেক্ষাপটও স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র মানুষ, স্বতন্ত্র জীবনবোধ, ভিন্নতর আঙ্গিক নির্মাণের মাধ্যমে তিনি ব্যক্তির ক্ষয়ে যাওয়া, ভাঙন, একাকিত্ব মানবমনস্তত্ত্ব ও অন্তঃসারশূন্যতা, দ্বন্দ্বমুখর জীবনকে সাহিত্যে রূপায়ণ করেছেন নতুন ভাবনায়, নতুন ধারায়। স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের নিরন্তর খেলাও আমরা প্রত্যক্ষ করি কোথাও কোথাও, যার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে ঐতিহাসিক নিরেট সত্য। সব মিলিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে আবুবকর সিদ্দিক স্বতন্ত্র ধারায় প্রবহমান, চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত। তিনি মানুষ এবং মানুষের শ্রেণিগত অবস্থান নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং অত্যন্ত দরদ ও দক্ষতার সঙ্গে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। এর পাশাপাশি তিনি তার গদ্যশৈলীতে নতুনত্ব এনেছেন যা বৈচিত্র্যপ্রয়াসী উপমাসমৃদ্ধ ও প্রতীকাশ্রয়ী।
তিনি গ্রামীণ জীবনের দ্বন্দ্বমুখরতা, মানুষের সঙ্কীর্ণতা ও ভন্ডামির মুখোশও উন্মোচন করেছেন অনায়াসে। তিনি কখনই নির্দিষ্ট ফ্রেমে বন্দি থেকে সাহিত্য রচনা করেননি। বারবার পটভূমি পরিবর্তন করেছেন এবং নানা রঙের সংগ্রামশীল জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত শিল্পসফলভাবে, যেখানে আবেগের ঘনঘটা একেবারেই অনুপস্থিত। আর এখানেই একজন কথাশিল্পীর সফলতা, সার্থকতা। এ কারণেই তিনি একজন শিল্পসফল কথানির্মাতা ও কবি।