সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নোবেলজয়ী নার্গিস মোহাম্মদী ও ইরানের নারী আন্দোলন

সুমন আমীন
  ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

ইরানের খ্যাতিমান মানবাধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদী এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার সাহসী লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এই সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। তিনি ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রথম মুসলিম নারী শিরিন এবাদির গড়া মানবাধিকার সংস্থা 'ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টার'-এর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০০১ সালে তেহরানে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি ইরানে নারীর অধিকার, রাজনৈতিক বন্দি এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। শিরিন এবাদির সঙ্গে আরো পাঁচজন বিশিষ্ট ইরানি আইনজীবী আব্দুল ফাত্তাহ সুলতানী, মোহাম্মদ আলী দাদখাহ, মোহাম্মদ শরীফ এবং মেহেদী আফশারজাদেহ এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। নার্গিস মোহাম্মদী ২০০৩ সালে এই সংগঠনে যোগদান করেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পর অদ্যাবধি ১৯ জন নারী এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির প্রধান বেরিত রেইস-অ্যান্ডারসেন বলেন, 'নারীদের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নার্গিস'। তিনি আরও বলেন, 'আমি যখন এই পুরস্কার ঘোষণা করছি, তখন তিনি কারাগারেই আছেন'। তিনি তাকে একজন 'মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে অভিহিত করেন।

নোবেল জয়ী শিরিন এবাদী ও নার্গিসকে অভিনন্দন জানান। অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেন, 'নার্গিসকে চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করায় ইরানের নারীরা গণতান্ত্রিক ও সমানাধিকার পাবেন বলে তিনি আশা করছেন।' তিনি আরও বলেন, 'এই পুরস্কারের জন্য নার্গিস মোহাম্মদী ও সব ইরানি নারীকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই পুরস্কার ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানে সংগঠিত নারী অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে সামনে আনবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ব্যবস্থার সংস্কার করা যাবে না।' নার্গিস মোহাম্মদীর পুরো নাম নার্গিস সাফিয়ে মোহাম্মদী। তিনি ১৯৭২ সালের ২১ এপ্রিল ইরানের জাঞ্জানে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন ইরানের জাঞ্জান, কোরবেহ, কারাজ ও ওশনাভিয়েহ শহরে। তিনি ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার। এই কারণে রাজনৈতিক ছাত্রগোষ্ঠী তাশাক্কোল দানেশজুয়ি রোশানগারান (আলোকিত ছাত্রগোষ্ঠী) এর সভা হতে গ্রেপ্তার হন। নার্গিস মোহাম্মদী ইরানে সংস্কারপন্থি সংবাদ পত্রের সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেন। দ্য রিফর্মস, দ্য স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড দ্য ট্যাকটিস ইত্যাদি তার রাজনৈতিক প্রবন্ধের বই। ১৯৯৯ সালে, তিনি সহকর্মী সংস্কারপন্থি সাংবাদিক ত্যাগী রাহমানিকে বিয়ে করেন।কিন্তু শিগগিরই তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাহমানী ১৪ বছর কারাদন্ড ভোগ করার পর ২০১২ সালে মুক্তি পান এবং তাদের দুই সন্তান নিয়ে ফ্রান্সে চলে যান। ৫১ বছর বয়সি নার্গিস মোহাম্মদী এখন পর্যন্ত ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন। পাঁচবার দোষী সাব্যস্ত হওয়া এই মানবাধিকারকর্মীকে ৩১ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে কারাগারেই কাটছে তার দিন। ২০১৬ সালের মে মাসে তাকে ১৬ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। মৃতু্যদন্ড রদ করার পক্ষে প্রচারাভিযান চালানো একটি মানবাধিকার আন্দোলন পরিচালনা করার দায়ে তাকে এই শাস্তি প্রদান করা হয়। ইরানি নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ের জন্য দীর্ঘদিন থেকেই আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন। শাহ এর আধুনিকীকরণ নীতি নারীগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার সুযোগ প্রদান করে। তখন তাদের হিজাব পরা বা না পরার স্বাধীনতা ছিল। ১৯৬৩ সালে ইরানি নারীরা ভোটের অধিকার পায়। ফ্যামিলি প্রোটেকশন অ্যাক্ট নারীদের বিয়ের বয়সসীমা বৃদ্ধি করে, বহুবিবাহ হ্রাস করে, অস্থায়ী বিয়ে সীমিত করে এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রভাব কমিয়ে আনে। রেজা শাহ পাহলভীর স্বেচ্ছাচারী শাসন ও দুর্নীতির কারণে ১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুলস্নাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামিক বিপস্নব সংঘটিত হয়। রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও এই বিপস্নবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পদযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তারা নার্স ও পরিচারিকার কাজে অংশ নিয়ে বিপস্নবকে সফল করেন। কিন্তু বিপস্নবের পর নতুন প্রশাসন তাদের অধিকারের বিষয়গুলো ছুড়ে ফেলে। ধীরে ধীরে নারীর পোশাক, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে তাদের ঘরের ভেতর বন্দি রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়। শাহ প্রশাসনের অধীনে অর্জিত অগ্রগতি নতুন প্রশাসনে রুদ্ধ হয়ে যায়। নারীর অধিকার আইনিভাবে খর্ব করা হলেও বিনা প্রতিবাদে ইরানের বিপস্নবী নারীরা মেনে নেয়নি। ১৯৯০-এর দশকে মহিলা সমাজকর্মীরা পরিবার আইনের আওতায় তাদের কেড়ে নেওয়া অধিকারগুলোর কয়েকটির পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিয়েবিচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রক্রিয়ার সূচনা করার স্বাধীনতা এবং নিজের হেফাজতে সন্তানের দায়িত্ব পেতে সফল হন। তারপর ১৯৮৩ সালে যখন ইরানে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করা হয় তখন নারীরা প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেন। ১৯৯৪ সালে ফেব্রম্নয়ারি মাসে হোমা দারারি জনসমক্ষে তার হিজাব খুলে ফেলেন এবং বাধ্যতামূলক পর্দা প্রথার প্রতিবাদ স্বরূপ নিজেকে আগুনে দগ্ধ করেন। ২০১৯ সালে সহর খোদায়ারি মহিলাদের ওপর প্রশাসনিক বর্বরতার প্রতীক হয়ে ওঠেন, যখন মাঠে চলা একটি ফুটবল ম্যাচ দেখার চেষ্টা করার দরুন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলে তিনি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। ২০২২ সালে কঠোর 'পোশাকবিধি' না মানার অভিযোগে রাজধানী তেহরানে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনীকে আটক করেছিল নীতি পুলিশ। সেখানে পুলিশ হেফাজতে তার মৃতু্য হলে সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভে অন্যতম ভূমিকা রাখেন নার্গিস মোহাম্মদী। বন্দিদশা থেকেই তিনি নারীদের ওপর নিপীড়নের বিষয়টি সামনে আনার লড়াই চালিয়ে গেছেন। তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে আছেন নার্গিস। গত বছর সেখান থেকে পাঠানো এক চিঠিতেও, সরকারবিরোধী বিক্ষোভের ঘটনায় আটক নারীরা কীভাবে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তার বিস্তারিত তুলে ধরেছিলেন তিনি। মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী নার্গিস মোহাম্মদী তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আলেকজান্ডার ল্যাঙ্গার পুরস্কার (২০০৯) এবং আন্দ্রেই সাখারভ পুরস্কার (২০১৮) অন্যতম। পৃথিবী এগিয়ে গেছে। মানুষ তার জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহ জয় করে চলেছে। গভীর সাগরের বুকে গড়ে তুলছে বিড়াটাকার স্থাপনা। আর মানব জাতির এতসব উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারীরাও তাদের শ্রম মেধা দিয়ে সমান ভূমিকা রাখছে। সভ্যতার এই অগ্রগতিতে পৃথিবীর সব দেশের, সব জাতি, বর্ণ ও ধর্মের নারীরা সমান অংশগ্রহণ করুক এটাই সবার কাম্য। নার্গিস মোহাম্মদীর মতো বিপস্নবী নারীদের কল্যাণে পৃথিবী সবার বসবাস যোগ্য হয়ে উঠুক। নারী বাঁচুক তার আপন মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে