কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল সংঘটিত হামলার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং’ (র)-এর প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
শুক্রবার (২ মে) পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন কাশ্মীর হামলার বিষয়ে টেলিগ্রাম নামক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গোপন নথি ফাঁস হওয়ার পর স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ফাঁস হওয়া নথিতে কী ছিল?
প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেলিগ্রাম মাধ্যমে ফাঁস হওয়া গোপন নথি ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং গণমাধ্যমের নেরেটিভ নিয়ন্ত্রণ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। এই নথিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পেহেলগামে হামলাটি ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’(চক্রান্তমূলক ছদ্ম হামলা)।
এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের ওপর দায় চাপিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায় এবং কাশ্মীর ইস্যু থেকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া। নথিতে আরও বলা হয়েছে যে, হামলার পর পাকিস্তানকে দায়ী করার আগে ৩৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল, যাতে অভিযোগটি বাস্তবসম্মত মনে হয়। তবে ভারতের মিডিয়া তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলে, যার ফলে গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনায় গাফিলতি ধরা পড়ে।
হামলার আগে প্রস্তুতি :
পেহেলগামে হামলার ৩৬-৪৮ ঘণ্টা আগে আনন্তনাগ জেলায় র-এর ফিল্ড অপারেটরদের এবং মিডিয়া প্রতিনিধি মোতায়েন করা হয়েছিল। পর্যটকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের অজুহাতে এই অপারেটররা কার্যক্রম শুরু করে।
এছাড়াও, হামলার ২-৪ ঘণ্টার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে ‘প্রত্যক্ষদর্শী’ তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল। ঘটনাস্থলের ছবি-ভিডিওকে ব্লার করে ভাইরাল করার মাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তি ছড়ানো :
নথিতে ২০০টির বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ষড়যন্ত্র’ প্রচারের মাধ্যমে কাশ্মিরের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরা হতো। যার পরিপ্রেক্ষিতে হামলার পরপরই ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম ও উগ্রপন্থি গোষ্ঠী একযোগে হামলাকারীদের পাকিস্তানি এবং মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত করে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর ভূমিকা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব :
ফাঁস হওয়া নথিতে একাধিকবার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, র অপারেশনটি নিজেরা শুরু করেনি, বরং এটি ‘উপরমহল’ থেকে দেওয়া নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নথি র-এর মধ্যে হিন্দুত্ববাদী আদর্শবিরোধী মতামতের প্রতিফলন হতে পারে। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এটি র-এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভক্তির ইঙ্গিত দেয় এবং কিছু সদস্য মোদি সরকারের কৌশলের বিরোধিতা করছেন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট :
নথিতে একে অপরকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভারত সফরের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছিল। এর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে সামনে আনা এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি সংগ্রহের চেষ্টা ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নর্দার্ন কমান্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে হামলার স্থান থেকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার ‘প্রমাণ’ হিসেবে কিছু কাগজপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
বিকল্প অপারেশন :
নথিতে একটি বিকল্প অপারেশন পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে। যদি পেহেলগাম অপারেশন ব্যর্থ হয়, তবে শোপিয়ান জেলায় একই ধরনের দ্বিতীয় অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা ছিল। ‘টেঙ্গো-এচো’ নামে একটি বিকল্প রুটও সক্রিয় রাখার নির্দেশ ছিল।
কাশ্মীরের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন :
পেহেলগামে হামলার পর, বিশেষভাবে কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রায় ৫ লাখ সেনা মোতায়েন করেছে, তারপরও কীভাবে হামলা সম্ভব হলো? পাকিস্তানের বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, কেন এই বিপুল সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও এত বড় হামলা ঘটল?
পেহেলগামে নিরাপত্তাহীনতা : পরিকল্পিত উদাসীনতা?
ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন যেখানে প্রায় ২০০০ পর্যটক পেহেলগামে আসা-যাওয়া করেন, সেখানে বিস্ময়করভাবে কোনো ধরনের সেনা, কমান্ডো, আধাসামরিক বাহিনী কিংবা পুলিশ মোতায়েন ছিল না। হামলার সময় কিংবা হামলার পরও নিরাপত্তা বাহিনীর তাৎক্ষণিক উপস্থিতি দেখা যায়নি, যা এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কাশ্মীর উপত্যকায় মোতায়েন রয়েছে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (CRPF), বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF), ইন্দো-তিব্বতীয় সীমান্ত পুলিশ (ITBP), সশস্ত্র সীমা বল (SSB) এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ (SOG)।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কাশ্মীর উপত্যকায় প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি সেনা সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এত নিরাপত্তার মধ্যেও কীভাবে এমন হামলা সম্ভব হলো- এ প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বিশ্লেষক।
ভারত সরকারের দুর্বল যুক্তি ও অসঙ্গতি :
পেহেলগামে হামলার পর সর্বদলীয় বৈঠকে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার স্বীকার করেছে তাদের গাফিলতি ছিল নিরাপত্তা নিয়ে। তারপর পেহেলগামে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি জুন মাসে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান সরকারকে না জানিয়ে ২০ এপ্রিল থেকেই পর্যটক পাঠানো শুরু করে পেহেলগামে।
এ যুক্তিকে বিশ্লেষকরা অযৌক্তিক ও দুর্বল বলছেন। কারণ, এত গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেও কীভাবে দু’হাজার পর্যটক ‘বিনা অনুমতিতে’ সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেহেলগামে প্রবেশ করলেন- এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেনি ভারত সরকার।
পূর্ব অভিজ্ঞতা ও ফলস ফ্ল্যাগ কৌশল :
পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন, মোদি সরকারের ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা বিস্ফোরণের সময় ৪০ জনের বেশি সেনা সদস্য নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, বিস্ফোরণে ব্যবহৃত ৩০০ কেজি আরডিএক্স কীভাবে কাশ্মীরে পৌঁছাল- সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তখনো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছিল হামলার আশঙ্কা নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, সেই হামলাকে ঘিরে তখনকার দেশটির জাতীয় নির্বাচনী প্রচারণায় নরেন্দ্র মোদির বিজেপি দেশপ্রেমের আবেগ কাজে লাগিয়ে বিপুল সমর্থন আদায় করে এবং একচেটিয়া জয়লাভ করে। তখন কাশ্মীরের তৎকালীন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক অভিযোগ করেন, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে চুপ থাকতে নির্দেশ দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি।
সরকারের নীরবতা ও উসকানিমূলক রাজনীতি :
এই হামলার পরও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ফাঁস হওয়া নথি বা গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ বিজেপি নেতারা এ ঘটনাকে ঘিরে উসকানিমূলক দেশপ্রেমের রাজনীতি শুরু করেছেন।
সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি সমর্থক উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তান ও মুসলমানদের এক কাতারে ফেলে ঘৃণাসূচক প্রচারণা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে দুজন মুসলিম নাগরিক এ ঘটনার জেরে প্রাণ হারিয়েছেন, যদিও দেশটির পুলিশ তা অস্বীকার করেছে। পাশাপাশি, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে ভারতীয় মুসলমানদের গণহারে গ্রেপ্তার করার অভিযোগ উঠেছে।
আন্তর্জাতিক প্রশ্ন ও অভ্যন্তরীণ সংকট :
পেহেলগামের হামলা এবং গোপন নথি ফাঁস হওয়ার পর ভারতের কাশ্মীরনীতি ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর পরিকল্পিত ভূমিকা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশনীতি নিয়েই প্রশ্ন তুলছে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে- নথিটি কীভাবে ফাঁস হলো এবং কারা এর পেছনে রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, র-এর ভেতরে হিন্দুত্ববাদী কৌশলের বিরোধিতাকারী একটি অংশ এ তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে।
ফাঁস হওয়া নথি কাশ্মীর হামলায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদী ভাবধারা এবং আন্তর্জাতিক কৌশল নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু করেছে।