সৌদি আরবের সমস্যাগুলোর প্রতীক ছিল বুরাইদাহ শহর। বিশ বছর আগের সে সময় পুলিশ শহরের রাস্তায় টহল দিতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় দোকানপাট বন্ধ থাকে কিনা, নারীরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বাইরে বের হয় কিনা ও নারী-পুরুষ এক সঙ্গে ঘোরাফেরা করে কিনা এসব বিষয়ে তারা নজরদারি চালাতো।
তখন সিনেমা বা কনসার্ট ছিল না। বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ শুধু পুরুষদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল। দুই দশক ধরে তেলের কম দাম থাকায় দেশটিতে নানা ধরনের সমস্যা ছিল।
তবে এখনকার বুরাইদাহ যেন একেবারেই আলাদা। শহরের মূল রাস্তায় নারী-পুরুষ নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করে। যুগলরা একসাথে হাঁটে কিংবা রেস্তোরাঁয় পাশাপাশি বসে খায়। সিনেমা হলে আরবি ও হলিউডের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
শহরের প্রান্তে একটি নারী ড্রাইভিং স্কুল জমজমাট ব্যবসা করছে। মোরাল পুলিশদের আর দেখা যায় না, সন্ত্রাসবাদও এখন কেবল অতীতের স্মৃতি।
যদিও বুরাইদাহ এখনো এক সমস্যার প্রতীক। অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের অভাব। সিনেমা হল ও ড্রাইভিং স্কুলের মতো নতুন কিছু সেবা খাতে কাজ সৃষ্টি হলেও, এখনো বেশিরভাগ চাকরি আমলাতন্ত্রেই সীমাবদ্ধ। শহরের একমাত্র উল্লেখযোগ্য শিল্প হলো খেজুর চাষ, যা প্রায় পুরোপুরি বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল।
এক দশক ধরে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের সামাজিক কড়াকড়ি শিথিল করা ও তেলনির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সামাজিক সংস্কারের গতি ছিল বিস্ময়কর; কিন্তু অর্থনৈতিক পুনর্গঠন খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছে। সৌদির পুরনো অর্থনৈতিক মডেল যেমন প্রচুর রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, ধর্মীয় কড়াকড়ি ও পণ্যে নির্ভরতার সমস্যাগুলো রয়ে গেছে।
ভিশন ২০৩০-এর সামাজিক সংস্কার অনেক জনপ্রিয়তা এনে দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে হলে অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রাগুলো পূরণ করতেই হবে।
এই পরিকল্পনায় রয়েছে চমকপ্রদ গিগা-প্রকল্প যেমন: বিশাল লিনিয়ার সিটি, মরুভূমির পাশে স্কি ভিলেজ, ৫০টি বিলাসবহুল হোটেল, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন ইত্যাদি। একই সঙ্গে চলছে পর্যটন, গাড়ি উৎপাদনসহ নতুন শিল্প গঠনের চেষ্টাও। সরকার এরই মধ্যে ৬০০টির বেশি সংস্কার প্রকল্প চালু করেছে।
২০১৮ থেকে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা, চাকরি ও ব্যবসা শুরু করার সুযোগ পেয়েছে। নিয়োগ বা বেতনে বৈষম্য করা এখন অবৈধ। নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ ২০ থেকে বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়েছে। সবচেয়ে দ্রুত প্রবেশ করেছে সেই নারীরা, যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক।
রাষ্ট্র স্পোর্টস ও বিনোদন খাতেও জোর দিয়েছে। জেদ্দায় ফর্মুলা ১ রেসের আগে পারফর্ম করেছেন জেনিফার লোপেজ। রাজধানী রিয়াদে রাতের আকাশের নিচে ডিজের সুরে তরুণরা নাচছে। এমন দৃশ্য এক সময় অকল্পনীয় ছিল।
২০১৭ সালে যেখানে পরিবারগুলো আয়ের ১২ শতাংশ ব্যয় করত খাওয়া-দাওয়া ও বিনোদনে, ২০২৪ সালে তা বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে।
২০১৬ সালে যেখানে রাতে থাকার জন্য পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৬ কোটি, ২০২৩ সালে তা বেড়ে ১০ কোটিরও বেশি হয়েছে। বেশিরভাগই স্থানীয়। বিদেশি পর্যটক এখনো অল্প, যদিও বিলাসবহুল রিসোর্টে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে।
সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক রূপান্তর এখনো ধীরগতির। তেল এখনো রপ্তানি ও রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। যদিও জিডিপিতে এর অংশ ৩৬ থেকে ২৬ শতাংশে নেমেছে, তারপরও তা অনেক বেশি। নির্মাণ, খুচরা বিক্রি ও আতিথেয়তাখাতে কিছু অগ্রগতি হলেও, সরকার-নির্ধারিত অন্যান্যখাত তেমন এগোয়নি।
মূলত সামাজিক পরিবর্তন রাতারাতি ঘটতে পারে, কিন্তু অর্থনৈতিক পরিবর্তন সময় নেয়। খনিজ খাত, বিশেষত স্বর্ণ ও বক্সাইটে কিছু সম্ভাবনা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রেও সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সৌরশক্তি ও হাইড্রোজেন উৎপাদনে।
কিছু খাতে সৌদি আরবের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব আছে। যেমন গাড়ি উৎপাদন ও সেমিকন্ডাক্টরখাত। ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ৫ লাখ ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনের লক্ষ্য থাকলেও, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ মোট মাত্র ৮০০টি গাড়ি কিট আকারে আমদানি করে অ্যাসেম্বল করা হয়েছে।
যথেষ্ট প্রণোদনা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ হয়নি। ২০২৪ সালে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ২০২৩ সালের তুলনায় কমেছে। লক্ষ্য পূরণে তা জিডিপির দ্বিগুণেরও বেশি হতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বেশ কিছু কারণে সৌদি আরবে বিনিয়োগে সতর্ক। ২০১৭-১৮ সালে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) যেভাবে বহু ধনী সৌদিকে রিয়াদের একটি বিলাসবহুল হোটেলে আটকিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছিলেন, তার স্মৃতি এখনো অনেকের মনে রয়ে গেছে।
পাশাপাশি ২০১৮ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার ঘটনায়ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরবে ব্যবসা করতে এখনো রাজনৈতিক যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরেও, সরকারি প্রকল্পে অর্থ পরিশোধে বিলম্ব ও চুক্তি-সংক্রান্ত বিরোধও অস্বাভাবিক নয়।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধও সৌদি আরবে বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতির প্রভাবে যদি বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দার দিকে যায়, তাহলে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও পুঁজি প্রবাহ কমে আসবে।
সৌদি শিক্ষার্থীরা কাতারি শিক্ষার্থীদের তুলনায়ও খারাপ করছে, যদিও শিক্ষা খাতে অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। অতীতে ধর্মীয় শিক্ষার ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়াই হয়তো এর একটি কারণ। তাছাড়া সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের কঠোর পরিশ্রমের উৎসাহ কমিয়ে দিয়েছে।
মানবসম্পদের সীমাবদ্ধতা আরেকটি বড় সমস্যা। সৌদি পুরুষদের অর্ধেকই এখনো সরকারি চাকরিতে কর্মরত। নারীদের অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক বৃদ্ধির পরেও এখনো তুলনামূলকভাবে কম। মধ্যপ্রাচ্যের স্কুলশিক্ষার্থীরা গাণিতিক, পাঠ্য ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ওইসিডি গড়ের চেয়ে অনেক নিচে।