শুধু যুদ্ধবিমানের পারফরম্যান্স নয়, বরং কোন পক্ষ তাদের সামরিক মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিকে কতটা দক্ষতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পেরেছে, সেটিই নির্ধারণ করেছে বিজয়।
হংকং-ভিত্তিক গণমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানিয়েছে, পাকিস্তান এই যুদ্ধে ব্যবহার করেছে তথাকথিত "এবিসি সিস্টেম"—যেখানে ভূমি-ভিত্তিক রাডার হচ্ছে 'এ', যুদ্ধবিমান 'বি' এবং এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম হলো 'সি'।
অর্থাৎ, তিন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নিখুঁতভাবে এক সিস্টেমে সংযুক্ত করেছে পাকিস্তান, যার সহায়তার ভারতের যুদ্ধবিমান শনাক্ত ও আক্রমণের জন্য সমন্বিত এক কৌশল গ্রহণ করে। এর মাধ্যমেই চীনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া পিএল-১৫ই দূরপাল্লার বিমান-বিধ্বংসী মিসাইলকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে পরিচালনা করেছে সাব-২০০০ বিমানভিত্তিক রাডার প্ল্যাটফর্ম বা এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম।
এই তথ্য আদান-প্রদানের সামর্থ্য পাকিস্তানকে একটি একক ও গতিশীল যুদ্ধ-পরিস্থিতির চিত্র দিতে পেরেছে। বিমানপ্রযুক্তি বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম এভিয়াসিঅনলাইন-এর বিশেষজ্ঞ গ্যাস্টন ডুবোয়া বলেন, পাকিস্তানের দেশীয় লিংক-১৭ ডেটালিংক ব্যবস্থাই এই আন্তঃসংযোগ সক্ষমতা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম এক ছাতার নিচে কাজ করতে পেরেছে। ফলে পাকিস্তান অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক বিমান দিয়ে—মাত্র ৪০টির মতো—ভারতের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকরভাবে প্রতিপক্ষের ওপর তথ্য-ভিত্তিক আধিপত্য অর্জন করে।
এই প্রসঙ্গে চায়না একাডেমির গবেষক ওয়াং জিয়াংসুই ও চারিওট ঝাই বলেছেন, পাকিস্তান ২০০০ সালের পর থেকে শুধু চীনের কাছ থেকেই যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছে এবং বর্তমানে মোট ছয় ধরনের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। অপরদিকে ভারতের বিমানবাহিনী অন্তত ১৪ ধরনের যুদ্ধবিমান পরিচালনা করছে, যেগুলোর উৎস পাঁচটি ভিন্ন দেশ। ফলে ভারতের কাছে অত্যাধুনিক ফ্রেঞ্চ বা রাশিয়ান যুদ্ধবিমান থাকলেও, সেগুলোর মধ্যে ডেটালিংক বা অস্ত্র গাইড করার মতো সংযোগ তৈরিতে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এককথায়, 'ডাইভার্সিটি' বা বৈচিত্র্য একসময় ভারতের জন্য শক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন তা দুর্বলতায় পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তির যুগে পারস্পরিক সংযোগ ও সমন্বয় না থাকলে প্রতিটি যুদ্ধবিমানই বিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর হয়ে পড়ে।
পিটার ম্যাটেস ২০১৯ সালে মিচেল ফোরামে লিখেছিলেন, সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (আইএডিএস) মানে শুধু কিছু রাডার বা ক্ষেপণাস্ত্র নয়—এটি হলো এক ধরনের ইকোসিস্টেম, যেখানে যুদ্ধবিমান, ভূমিভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার, কমান্ড সেন্টার, এবং যোগাযোগব্যবস্থা একত্রে কাজ করে একটি সুসংগঠিত প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করতে। এই পদ্ধতির সার্থকতা পাকিস্তান এই যুদ্ধেই দেখিয়েছে।
সদ্য সংঘটিত এই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্যও এক বড় শিক্ষা। এই অঞ্চলের অনেক দেশ এখনও পুরনো কাঠামোতে যুদ্ধবিমান কিনছে—যার পেছনে থাকে রাজনীতি, প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন, কিংবা আন্তর্জাতিক চাপ। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে—নতুন যুদ্ধবিমান মানেই আধুনিক যুদ্ধক্ষমতা নয়।
উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২৪টি এফ-১৬ ফাইটার জেট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু তাদের বিমানবাহিনী এখনও রাশিয়ান প্ল্যাটফর্মনির্ভর। ফলে এই নতুন বিমানের জন্য প্রয়োজন নতুন প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ কাঠামো, এমনকি আলাদা কমিউনিকেশন ও অস্ত্র ব্যবস্থা—যা আসলে একটা ভিন্ন বিমান বাহিনী গড়ার মতোই জটিল।
ইন্দোনেশিয়া আবার একধাপে ৪২টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার ঘোষণা দিয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৮.১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ইতিমধ্যেই তাদের বিমানবহর জটিল এক মিশ্রণে পরিণত হয়েছে, যেখানে রয়েছে এফ-১৬, সুখই-২৭ এবং সুখই-৩০, যার সঙ্গে এখন যুক্ত হবে রাফাল-ও। এই ধরণের বহুবিধ প্ল্যাটফর্ম ব্যবস্থাপনায় শুধু খরচই বাড়ে না, যুদ্ধকালীন সংকটে কার্যকর সংযোগও ভেঙে পড়ে।
মালয়েশিয়াও একই সমস্যায় পড়েছে—তাদের সুখই-৩০ এমকেএম বহর রক্ষণাবেক্ষণে সংকট তৈরি হয়েছে রাশিয়ান যন্ত্রাংশের অভাব। এখন তারা পুরোনো প্রজন্মের কুয়েতি এফ/এ-১৮ যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করতে চাচ্ছে, যা প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে এবং তাদের বর্তমান বহরের সঙ্গেও সমন্বয় করে না।
অর্থাৎ, আজকের বাস্তবতায় যুদ্ধবিমান মানেই শুধু ফ্লাইট পারফরম্যান্স নয়—এটি একটি পূর্ণাঙ্গ, সমন্বিত যুদ্ধব্যবস্থার অংশ। দক্ষতা নির্ধারণ করছে কে কত দ্রুত তথ্য শেয়ার করতে পারে, কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এবং কতটা সমন্বিতভাবে একাধিক প্ল্যাটফর্ম একসঙ্গে কাজ করতে পারে। সেক্ষেত্রে এক নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারাটাই প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ আধুনিক আকাশযুদ্ধে এক সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রতিপক্ষের এগিয়ে থাকাটাও হয়ে ওঠে মারাত্নক এবং পরাজয়ের কারণ।
কাশ্মীর সংঘর্ষ আমাদের সেই পাঠই দিয়েছে—বিচ্ছিন্ন যন্ত্রের জট নয়, বরং তথ্য-ভিত্তিক সমন্বয়ই আগামী যুদ্ধের মেরুদণ্ড। প্রস্তুতি না থাকলে যত আধুনিক যুদ্ধবিমানই থাকুক, তারা একেকটি ব্যয়বহুল অথচ অকার্যকর যন্ত্রে পরিণত হতে বাধ্য।