অ্যান্টিবায়োটিক অ্যামোক্সিসিলিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। নিউমোনিয়া, আলসারের মতো নানা ধরনের সংক্রমণের চিকিৎসায় প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ আস্থা রাখে অ্যামোক্সিসিলিনে। কিন্তু খুব কম মানুষ জানে, পুরো আমেরিকায় এই অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে মাত্র একটি কোম্পানি। এর চেয়েও আশ্চর্যজনক তথ্য, এই ওষুধ তৈরির জন্য দরকারি কাঁচামালের ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফার্মাসিউটিক্যাল আমদানিতে শুল্ক আরোপের হুমকির পর এ নির্ভরতা এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, চীন যদি তাদের সরবরাহ চেইনকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ ওষুধ সংকটে পড়তে পারে।
অ্যামোক্সিসিলিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইউএসঅ্যান্টিবায়োটিকসের মালিক রিক জ্যাকসন বলেন, বেইজিং যদি তাদের সরবরাহ ক্ষমতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে তা অ্যামোক্সিসিলিনসহ বহু ওষুধের জোগান ধ্বংস করে দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর দেশটির হাইড্রোকরটিসন আমদানির ৯৬ শতাংশ, আইবুপ্রোফেনের ৯০ শতাংশ ও অ্যাসিটামিনোফেনের ৭৩ শতাংশ এসেছে চীন থেকে। এসব সাধারণ ওষুধই মূলত প্রতিদিনের চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা আরো বাড়তে থাকলে চীন যে ওষুধ রফতানিকে চাপ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, তা আর অনুমানের বিষয় নয়। যদিও চীন এখনও পর্যন্ত ওষুধ খাতে সরাসরি কোনো হুমকি দেয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মনে করছেন, চীনের ‘চোকপয়েন্ট’ ক্ষমতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
ওষুধ খাতে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার বিষয়ে ২০১৯ সালেই কংগ্রেসকে সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন ইকোনমিক অ্যান্ড সিকিউরিটি রিভিউ কমিশন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘাটতির শেকড় রয়েছে বহু আগের শিল্পনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় বহু বছর আগেই ওষুধ উৎপাদনের কেন্দ্র চলে গেছে চীন ও ভারতে। বিশেষ করে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস ও কেমিক্যাল স্টার্টিং ম্যাটেরিয়াল তৈরিতে চীনের আধিপত্য এখন একচেটিয়া।
ওষুধ শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারক সংস্থা ইউএস ফার্মাকোপিয়ারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস উৎপাদনে চীন ও ভারত মিলে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ফাইলিং জমা দিয়েছে। ২০২১ সালের পরবর্তী দুই বছরে ভারতের অংশীদারত্ব কমে ৫০ শতাংশে এলেও, চীনের অংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ শতাংশে।
চীনের এ বিস্তার কেবল উৎপাদন খরচ কম থাকায় নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার ফলেও। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষিত ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতিতে বায়োফার্মা খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরপর থেকেই কেমিক্যাল শিল্পের সুবিধা নিয়ে চীন গড়ে তোলে ওষুধ উৎপাদনের শক্তিশালী ক্লাস্টার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মহামারির সময় চীন যেমন চিকিৎসা সরঞ্জাম রফতানির মাধ্যমে বৈশ্বিকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তেমনিভাবে ওষুধ সরবরাহকেও কৌশলগত চাপ হিসেবে ব্যবহার করার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। ২০২১ সালে এক বক্তৃতায় চীনা অর্থনীতিবিদ লি দাওকুই বলেন, ‘আমরা যদি চাই, তাহলে ভিটামিন আর অ্যান্টিবায়োটিক রফতানি বন্ধ করে দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে পারি।’
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে জেনেরিক ওষুধই মূল চালিকা শক্তি। মোট প্রেসক্রিপশনের ৯০ শতাংশই এ ক্যাটাগরির। অথচ এগুলোর উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ ও মুনাফা কম হওয়ায় দেশীয় উৎপাদকরা এতে আগ্রহী নয়। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শুল্ক আরোপ যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এই জেনেরিক ওষুধগুলোর দাম হু-হু করে বাড়বে, অনেক কোম্পানি হয়তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরেও যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মা লবি সংস্থার এক গবেষণা বলছে, ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে বছরে আমদানি ওষুধের খরচ ৫০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে। এমনকি একটি সাধারণ ক্যান্সার জেনেরিক ওষুধের ২৪ সপ্তাহের কোর্সের দাম বেড়ে যেতে পারে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত।
এমন পরিস্থিতিতে ওষুধ শিল্পে নিজ দেশের নির্ভরশীলতা বাড়াতে ট্রাম্পের শুল্ককে কার্যকর সমাধান হিসেবে দেখছেন না কেউই। বরং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সরকারি সহায়তা ও নির্ভরযোগ্য সরবরাহ চেইন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।