শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অনবদ্য ব্যবস্থাপনায় সাবলীল হজ 

মোঃ আবুবকর সিদ্দীক
  ১২ জুন ২০২৫, ২০:১৩
অনবদ্য ব্যবস্থাপনায় সাবলীল হজ 
ছবি: যায়যায়দিন

২০২৫ সনের হজের আনুষ্ঠানিকতা মাত্রই শেষ হয়েছে। এবছরের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আগত হজযাত্রীর তাৎক্ষণিক মন্তব্য মিলেছে। কেউ কেউ পত্রিকায় নিবন্ধও লিখেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে অনেকেই হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন; নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া খুবই নগন্য। সুষ্ঠু ও সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টার ফেসবুকের একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের এরূপ উপলব্ধি ও প্রশংসাসূচক মন্তব্য ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টদেরকে পুলকিত করার চেয়ে তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতাকেই সুতীব্র করে। অধিকন্তু, ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে আরো শানিত ও কার্যকর করার প্রতি সংশ্লিষ্টদের অভিনিবেশ সুতীক্ষ্ণ হয়।

জুলাই বিপ্লবের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনা ছিলো সরকার তথা ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই হজের খরচ কমানোসহ সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে-এরূপ জন আকাঙ্ক্ষা ছিলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যম ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এধরণের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্যদিকে, হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের নতুন নতুন আইন-কানুন বা বিধিবিধানের কারণেও সরকারকে মাঝে মাঝে কিছু স‌ঙ্কটের সম্মূখীন হতে হয়েছে।

1

প্রথমেই বলা রাখা প্রয়োজন, হজ ব্যবস্থাপনা মূলত বাংলাদেশ ও সৌদি প্রান্তে সম্পন্ন হয়। এ প্রান্তের ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। তবে সৌদি প্রান্তের বিষয়টি সেদেশের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করে থাকে। একারণে হজ ব্যবস্থাপনার একটি বিশাল অংশে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা রাখার তেমন সুযোগ নেই। বিশেষ করে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে সৌদি সরকারের নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র।

হজের খরচ যৌক্তিকীকরণের বিষয়টি ছিলো সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। সেলক্ষ্যে সরকার

যথাসাধ্য চেষ্টা করে। তবে বাস্তবতা হলো হজের খরচের যে খাতসমূহ রয়েছে তার অধিকাংশের খরচই সৌদি সরকার নির্ধারিত। বিমানভাড়া ও হোটেল ভাড়া-এই দুটি খাত ছাড়া উল্লেখ্যযোগ্য কোন খাতে খরচ কমানোর বিষয়ে দর কষাকষির সুযোগ নেই। হোটেল ভাড়া প্রধানত হারাম শরীফ হতে হোটেলের দূরত্ব ও হোটেলের মানের তারতম্য অনুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে।

হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার দিনগুলোতে মিনা ও আরাফায় তাবুতে আবাসন, সেখানে অবস্থানকালে দেয় খাবারের মূল্য প্রভৃতি তাবুর জোন ও প্যাকজভিত্তিক নির্ধারিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু তাবুর জোন ও প্যাকেজ নির্বাচন করা ব্যতীত দর কষাকষির কোন সুযোগ কোন দেশেরই নেই। সেবার মানভেদেই সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া, ভিসা ফি, স্বাস্থ্যবীমা, জমজমের পানিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও নির্ধারিত।

এদেশ হতে হজযাত্রায় বিমানভাড়া নিয়ে নানারূপ আলোচনা-সমালোচনা আছে। বিমানভাড়া নির্ধারণের জন্য হজ প্যাকেজ ঘোষণার পূর্বে বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনের সাথে কয়েকদফা মতবিনিময় বা সভা করে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তৎকালীন বিমান উপদেষ্টার সাথে আলোচনা করা হয়। ফলস্বরুপ, বিমান ভাড়া গতবারের তুলনায় ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমাতে সক্ষম হয় সরকার। এদেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় সরকার বাড়ি বা হোটেল ভাড়া করার ক্ষেত্রেও যতটা সম্ভব দর কষাকষি করে এবং অত্যন্ত যৌক্তিক মূল্যে বাড়ি ভাড়া প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত কমিটি। এবছর সৌদি রিয়ালের মূল্য গত বছরের তুলনায় প্রায় ২ টাকা বেড়েছে। কিছু সার্ভিস চার্জও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত বছরের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে।

হজ এজেন্সির মাধ্যমে হজযাত্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে সৌদি হজ ও উমরাহ মন্ত্রণালয় হতে প্রতিবছর হজযাত্রীর ন্যূনতম সংখ্যা বা কোটা নির্ধারণ করে থাকে। গত ২০২৪ হজ মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য এই ন্যূনতম কোটা ছিলো ২৫০ জন। কিন্তু এ মৌসুমে সৌদি সরকার বাংলাদেশের হজ এজেন্সি প্রতি সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা ২০০০ জন নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে সৌদি হজ ও উমরাহ মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে হজ এজেন্সি প্রতি সর্বনিম্ন হজযাত্রীর কোটা একহাজার নির্ধারণ করাতে সক্ষম হয় সরকার। তবে লিড এজেন্সি গঠন নিয়ে সংকট ঘনীভূত হয়। জুলাই বিপ্লবের পরে হজ এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ(হাব) এর কমিটি নিয়েও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন বিভাগ/সংস্থা এবং হজ এজেন্সিসমূহের সহযোগিতায় সরকার ৭০টি লিড এজেন্সি গঠন করতে সমর্থ হয়। এই লিড এজেন্সিসমূহের অধীনেই বেসরকারি মাধ্যমের হজযাত্রীরা এবছর হজ পালন করেছেন।

১৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হজযাত্রীদের জন্য মিনা ও আরাফায় তাবু বরাদ্দ নেওয়া এবং ক্যাটারিং সার্ভিস কোম্পানীর সাথে চুক্তি সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সৌদি সরকার। এটিও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান, কঠোর মনিটরিং ও ফলো-আপ তৎপরতার কারণে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। এরপর সৌদি সরকারের নির্দেশনা অনুসারে Nusuk Masar প্লাটফর্মে বাড়িভাড়া ও পরিবহন চুক্তি সম্পাদিত হয়। সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপে এ বছর সরকারি-বেসরকারি উভয় মাধ্যমে নিবন্ধিত হজযাত্রীদের ভিসার বিষয়টিও সম্পন্ন হয়।

এ মৌসুমের হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন সংযোজন হলো 'লাব্বাইক' মোবাইল অ্যাপ। সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হজের সফরকে সহজ, মসৃণ, নিরাপদ এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিরসনে এই অ্যাপটি তৈরি করা হয়। এই অ্যাপের মাধ্যমে লোকেশন ট্র্যাকিং, নামাজের সময়সূচি, প্রতিদিনের করণীয়, দৈনিক হজ সিডিউল, হজযাত্রী ফ্লাইটের বিস্তারিত তথ্য, বাংলাদেশ মেডিক্যাল সেন্টার ও সৌদি হাসপাতালের তথ্যসহ একগুচ্ছ প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তির দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

এবছর হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন যুক্ত হয়েছে হজ প্রি-পেইড কার্ড। হজযাত্রা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে চালু করে সরকারের অনুরোধে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এই কার্ড চালু করে। এই কার্ড নগদ টাকার পরিপূরক। এ কার্ডে বাংলাদেশি টাকা লোড করে ডলার/সৌদি রিয়াল পাওয়া যায়। POS মেশিনে পেমেন্ট সুবিধাও রয়েছে এই হজ প্রিপেইড কার্ডে।

সরকারের পরামর্শে হজযাত্রীদের জন্য ‘গ্রামীণফোন’, ‘বাংলালিংক’ ও ‘রবি’ বিশেষ ফোন রোমিং প্যাকেজ চালু করে। এর ফলে হাজীগণ সৌদি আরবে মোবাইল সিম ক্রয় ছাড়াই বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিজস্ব মোবাইল সিমের মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে।

হজ ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন দল গঠনে জনবলের সংখ্যা যতটা সম্ভব যৌক্তিক করার চেষ্টা করে সরকার। গত বছর এসকল দলের মোট সদস্য ছিলো ৩৬৬ জন, এবছর সেই সংখ্যা কমিয়ে ২৯৩ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে।

হজযাত্রীদের সেবায় মক্কা ও মদিনার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিযুক্ত করা হয় হজকর্মী। হজযাত্রীদের যেকোন অভিযোগ/অনুযোগ খতিয়ে দেখে তাৎক্ষণিক সমাধানেরও চেষ্টা করা হয়। মিনায় এদেশীয় হাজীদের সেবায় সুনির্দিষ্ট দায়িত্বসহ গঠন করা হয় ১৮ টি টীম।

এবার হজযাত্রীদের লাগেজ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ধর্ম উপদেষ্টা ও ধর্ম সচিবের দিকনির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ সংক্রান্ত কমিটি প্রায় শতভাগ লাগেজ হজযাত্রীদের হাতে পৌঁছে দিতে পেরেছে।

হজ ফ্লাইটের মধ্যবর্তী পর্যায়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সংখ্যা বেশি থাকায় এবং হজ এজেন্সির বাড়িভাড়ার সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় হজযাত্রী পরিবহনে কিছুটা শঙ্কা দেখা দেয়। সেটিও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হজযাত্রী পরিবহনকারী তিনটি এয়ারলাইন্সের সাথে সমন্বয় করে সকল হজযাত্রীকে সৌদি আরব প্রেরণ করতে সক্ষম হয়।

এবছর হজ ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাওয়া গেছে। উদ্ভূত সকল পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অকুণ্ঠ সহায়তা করেছেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সুষ্ঠু ও সাবলীল হজ ব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পেশাদারিত্ব ও দূরদর্শিতার সাথে নিবীড়ভাবে কাজ করেছেন। সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটির দিনগুলোতে ধর্ম সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা দপ্তরে কাজ করেছেন। যখনই কোন ইস্যু সামনে এসেছে তখনই সেটা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এমনকি কোনো ইস্যু সামনে আসতে পারে-এরূপ সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ।

হজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এদেশের গণমাধ্যমসমূহ সবসময় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। হজ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে দেশবাসিকে অবহিত করেছে এবং নানা তথ্য দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছে।

হজ ব্যবস্থাপনা একটি টীম ওয়ার্ক। সকলে মিলে টীম স্পিরিট নিয়ে কাজ করতে পারলে যেকোন ব্যবস্থাপনাই সুন্দর ও সাবলীল হবে-এটাই স্বাভাবিক। এবছরের হজ ব্যবস্থাপনা তারই প্রতিচ্ছবি।

এবছরের হজ ব্যবস্থাপনা সর্বৈব সুন্দর হয়েছে এরূপে যারা বলেছেন বা বলতে চেয়েছেন তাদের মূল্যায়নে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। তবে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে এবারও সামান্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও পরিস্থিতি ছিলো নিয়ন্ত্রণে। ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যূতির জন্য ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট হাজীদের নিকট দুঃখ প্রকাশ করছে। এবার যে ত্রুটিসমূহ গোচরে এসেছে তা আগামীতে যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেবিষয়ে মন্ত্রণালয় সচেষ্ট থাকবে। অনিন্দ্য ব্যবস্থাপনায় সাবলীল হজ নিশ্চিত করতে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সদা তৎপর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে