জীবন নিয়ে নেই কোনো স্বপ্ন কিংবা আকাঙ্ক্ষা।রাস্তার সস্তা জীবনে আছে শুধু কেবল একটি চাহিদা।যার নাম জুতার কষ বা ড্যান্ডি। এই জুতার কষই বশ করে নিয়েছে অগণিত শিশুর জীবন।ড্যান্ডিতে বন্দী যেন তাদের জীবন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর রাস্তার পাশে অগণিত শিশুর হাতে দেখা যায় জুতার কষ বা ড্যান্ডি খাওয়ার দৃশ্য।
এসকল পথশিশুরা রাস্তায় বা ডাজবিনে পড়ে থাকা ভাঙারি কুড়িয়ে বিক্রি করে যা টাকা হয় তা দিয়ে ড্যান্ডি খায়। এসকল ড্যান্ডি বা গ্যাম মূলত সাইকেল বা রিকশার টায়ার-টিউব কিংবা জুতা সারাতে যে আঠা ব্যবহার হয় তাই ড্যান্ডি। এর প্রকৃত নাম ড্যান্ড্রাইট আঠা।এই ড্যান্ড্রাইট আঠা মূলত ছোটখাটো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, চামড়া ও প্লাস্টিকের পণ্য জোড়া লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
ড্যান্ড্রাইট আঠার ঘ্রাণ মানুষের মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ক্ষণস্থায়ী সেই অনুভূতি থেকে তৈরি হয় আসক্তি। যে আসক্তি পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
পথশিশুরা ড্যান্ড্রাইট জাতীয় আঠা পলিথিনের মধ্যে ভরে সেখান থেকে শ্বাস ফুসফুসে টেনে নেয়। প্রথমে পলিথিনে আঠা ঢুকিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝাঁকানো হয়। পলিথিনের ব্যাগ বাতাস দিয়ে ফুলালে সৃষ্টি হয় তীব্র গন্ধযুক্ত গ্যাস। এরপর পলিথিন থেকে সেই গ্যাস নাক ও মুখ দিয়ে টেনে নেয় তারা; যা চলে যায় দেহে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও জামাকাপড়ে ড্যান্ডির গাম লাগিয়ে নাক দিয়ে টানে তারা। এই গ্যাস ফুসফুসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর নেশাময় হয়।
শুধু ড্যান্ড্রাইট জাতীয় আঠা যে এই পথশিশুরাই খায় তা নয়, এরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ড্যান্ড্রাইট জাতীয় আঠা খায়।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্র বলছে, এই নেশার ফলে অ্যাডহেসিভ শরীরের ভেতরে বাসা বাঁধে। শরীরের যেসব জায়গায় অ্যাডহেসিভ পৌঁছায়, সে জায়গার কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। আর কোষ নষ্ট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কেও অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
এছাড়াও, এই আঠা নাকের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করে। এ ধরনের মাদকে শারীরিক এবং মানসিক উভয় ধরনের প্রভাব ফেলে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া হয় আরো ভয়াবহ। এছাড়াও এই মাদক সেবনের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া, রাতে বিছানায় প্রস্রাব করার মতো বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের আশ্রয়হীন ভাসমান শিশুদের মধ্যে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ ড্যান্ডিতে আসক্ত। এছাড়াও বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের আরেকটি গবেষণা জানাচ্ছে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত। তাদের ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ শিশু ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট, ৮ শতাংশ শিশু ইনজেকশনে আসক্ত। ঢাকা শহরের পথশিশুরা সাধারণত সিগারেট, গাঁজা, ড্যান্ডি ও পেট্রল শুঁকে নেশা করে। তবে পথশিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ড্যান্ডির নেশায়৷
পথশিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ড্যান্ডি সেবনে ক্ষুধামন্দা তৈরি হয়। ঝিমুনি আসে, রাস্তাঘাটে, স্টেশনে কিংবা ফুটপাতে যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে পড়া যায়। শিশুরা ক্ষুধার জ্বালা ভুলতে ও ভালো করে ঘুমানোর আশায় ড্যান্ডি খায়। ঘুমিয়ে যেতে পারলে তখন আর ক্ষুধার কথা মনে থাকে না। এ ছাড়াও একাকীত্বের কষ্ট বা সঙ্গ দোষে এই ধরনের মাদকে অভ্যস্ত হচ্ছে ভাসমান পথশিশুরা। একাধিক পথশিশুদের ভাষ্য, দিনে একবার ড্যান্ডি খেলে সারাদিন কারো কথা মনে পড়ে না।
এক পথশিশু জানায়, ছোট সাইজের গাম ৫০ টাকায় সংগ্রহ করা যায়। আবার ১০০ টাকায়ও কেনা যায়, যা একটি কিনে দুই থেকে তিনজনে ভাগ করে নিলেই হয়। এতে ভাগে পড়ে ৩০-৫০ টাকা। ড্যান্ডি আসক্তরা পুরো কৌটা কিংবা টিউব কেনে না। তারা যে যার প্রয়োজন অনুপাতে ইলেকট্রনিক পণ্য মেরামতের দোকান বা জুতা মেরামতকারীদের (মুচি) কাছ থেকে অল্প করে সংগ্রহ করে।
রাজধানীর মোটামুটি সব এলাকায় পথশিশুর হাতে দেখা মিলবে ড্যান্ডি। এর মধ্যে সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, কমলাপুর, খিলগাঁও, মুগদা, মতিঝিল, মহাখালী, কারওয়ান বাজার, গাবতলী, আমিনবাজার, টঙ্গী এলাকায় এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্থান রয়েছে, যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে।
যাযাদি/ এম