সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

‘কখন আসবে জাওয়াদের ফোন’

যাযাদি ডেস্ক
  ১০ মে ২০২৪, ২০:২২
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের এ ছবি শুধুই স্মৃতি। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের আগুনের ঘটনায় একজন পাইলট নিহত হন। গতকাল বৃহস্পতিবার আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় আগুন ধরে চট্টগ্রামে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি গড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর মোহনায়। এর আগে বিমানের পাইলট ও কো-পাইলট প্যারাসুটে মাটিতে অবতরণ করে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাইলট অসীম জাওয়াদের মৃত্যু ঘটে।

জানা যায়, ‘সিনেমার গল্পটা বাস্তবে মঞ্চায়ন করলেন স্কোয়াড্রেন লিডার আসিম জাওয়াদ, সাথে ছিলেন উইং কমান্ডার সোহান হাসান খান! প্লেনে আগুন ধরলে জীবন বাজি রেখে লোকালয় থেকে দূরে নদীর উপর নিয়ে যান! শেষ মুহূর্তে প্যারাসুট দিয়ে প্লেন থেকে বের হতে পারলেও শেষ রক্ষা হয়নি জাওয়াদের! হয়তো আরও আগে বেরিয়ে যেতে পারতেন! কিন্তু বীরের মত নিজের জীবনের বিনিময়ে অনেকগুলো জীবন বাঁচিয়ে প্রমাণ করেছেন, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউররা এখনও এদেশে জন্ম নেয়!’

এভাবে হাসতে হাসতে দেশের জন্য জীবন দিতে পারে ক’জনই! বেঁচে থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা কাজে না লাগিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারে ক’জনই!

বর্তমান সময়ে এসে দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এক তরুণ। তার নাম স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ। ৩১ বছর বয়সী এই তরুণের মৃত্যু হয়। তার এই আত্মত্যাগকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বীরের সঙ্গে তুলনা করছেন, আবার কেউ বা বলছেন দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে বৃহস্পতিবার (৯ মে) সকাল ১০ টা ২৫ মিনিটে উড্ডয়ন করেছিল ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান। নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার মো. সোহান হাসান খাঁন এবং স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমানটি নিয়ে আকাশে উড়ছিলেন। হঠাৎ প্রশিক্ষণ বিমানে আগুন ধরলেও দুই বৈমানিক (পাইলট) হারাননি সাহস। দক্ষতার সঙ্গে বিমানটি ঘনবসতিপূর্ণ চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা থেকে জনবিরল স্থানে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে কর্ণফুলী নদীতে এসে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেন দুই পাইলট। তবে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের (৩২) জীবন বাঁচেনি। অন্য পাইলটও গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি এখন হাসপাতালে।

স্থানীয়দের ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শুরুতে বিমানের পেছনের অংশে আগুন লাগে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিমানটিতে। এরপর সেটি টুকরা হয়ে পানিতে ছিটকে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মাতব্বর ঘাট দিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে চট্টগ্রাম নগরে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি বিমান উড়ে আসতে দেখেন। হঠাৎ দেখেন, বিমানের পেছনে আগুন ধরেছে। মুহূর্তের মধ্যে বিমানটি নদীতে আছড়ে পড়ে। বিমান থেকে দু’জন পাইলট প্যারাসুট নিয়ে নদীতে পড়ে যান। এ সময় নৌকার মাঝি ও যাত্রীরা মিলে তাদের উদ্ধার করে নগরের পতেঙ্গা প্রান্তের ঘাটে নিয়ে যান। পরে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর লোকজন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা জানান, বিধ্বস্ত বিমানটির পাইলটদের উদ্ধার করে বানৌজা পতেঙ্গা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের মৃত্যু হয়।

পেশাগত জীবনে সাফল্যে উজ্জ্বল আসিম জাওয়াদ

মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদের জন্ম ১৯৯২ সালের ২০ মার্চ মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার গোপালপুর গ্রামে। তিনি ২০০৭ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে বিএসসি (অ্যারো) পাস করেন।

জাওয়াদ ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি ক্যাডেটের সর্বোচ্চ সম্মান সোর্ড অব অনার প্রাপ্তিসহ জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন। চাকরিকালে তিনি বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি ও ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি পেশাদারি দক্ষতা ও সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘মফিজ ট্রফি’, ‘বিমানবাহিনী প্রধান ট্রফি’ ও বিমানবাহিনী প্রধানের প্রশংসাপত্র পেয়েছেন। এ ছাড়া ভারতীয় বিমানবাহিনীতে কোর্সে অংশ নিয়ে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘চিফ অব এয়ার স্টাফ ট্রফি ফর বেস্ট ইন ফ্লাইং’ অর্জন করেন।

‘কখন আসবে জাওয়াদের ফোন’

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জ শহরের পৌর ভূমি অফিসের সামনের গোল্ডেন টাওয়ারের সাততলায় থাকেন আসিম জাওয়াদের মা-বাবা। ছেলের মৃত্যুর খবরে পাগলপ্রায় হয়ে বিলাপ করছেন জাওয়াদের মা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নীলুফা আক্তার খানম। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমার ছেলে প্রতিদিন সকালে ফোন করে। আজ এখনও করেনি। কখন আসবে জাওয়াদের ফোন!’

নীলুফা আক্তার খানম ও ডা. আমান উল্লাহর একমাত্র সন্তান ছিলেন জাওয়াদ। বাবা আমান উল্লাহ নবীনগর এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। জাওয়াদ আট বছর আগে নারায়ণগঞ্জের রিফাত অন্তরাকে বিয়ে করেন। তাদের ছয় বছরের একটি মেয়ে ও এক বছরের ছেলে আছে। তারা চট্টগ্রামেই থাকেন।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে