মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১

জুলাই বিপ্লবের শহীদ ছাত্র-জনতার রক্তদানকে অস্বীকার ও অবমাননা করে চলছে কোটায় নিয়োগের প্রক্রিয়া

জাহাঙ্গীর আলম, বিশেষ প্রতিনিধি
  ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:৫৫
আপডেট  : ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৯
ফাইল ছবি

জাতির প্রত্যাশা ছিল- ০৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর সরকারি দপ্তরসমূহে তাদের আজ্ঞাবহ ও পদলেহনকারী দোসরমুক্ত হবে। প্রায় দুই মাস পার হতে চললো তবুও কারা অধিদপ্তর এখনও চলছে বিগত সরকারের অনুগত কর্মকর্তা কর্ণেল শেখ সুজাউর রহমান গং এর নিয়ন্ত্রণে।

বিতর্কিত এই সেনা কর্মকর্তার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায় হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে পরিচয় দেন খুলনা জেলার মানুষ বলে। খুলনা শহরে নিরালা আবাসিক এলাকায় বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি। নিজ শশুরবাড়ি বাগেরহাটে হলেও সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তা থাকেন খুলনার বানিয়াখামার এলাকায়। সুজাউর এর সরকারি গাড়ি থাকলেও তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমেরিকান জেনারেল মটরস এর কোটি টাকা মূল্যের জিপ গাড়ি ব্যবহার করেন। নিয়োগ বানিজ্যের অবৈধ কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। তার এই অবৈধ অর্থ দিয়ে কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি যেখানে তার পরিবার-পরিজন সেখানে থাকেন।

এই সেনা কর্মকর্তার এক শ্যালক ডা. নেওয়াজ মোস্তাফিজ স্বাচিপ খুলনা শাখার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নেওয়াজ ছাত্রজীবনে খুলনা মেডিকেলের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আরেক শ্যালক এন.এস.আই কর্মকর্তা। গোপালগঞ্জ জেলার প্রভাব খাটিয়ে এই কর্মকর্তা ভাগিয়ে নেন অতিরিক্ত কারা মহা পরিদর্শকের গুরুত্বপূর্ণ পদ। নিয়োগ বাণিজ্য এবং কারা অধিদপ্তর সহ কারাগারগুলোর বিভিন্ন প্রকার মালামাল( কারা কর্মচারী ও বন্দিদের রেশনের তৈল, কারারক্ষিদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, বন্দিদের কম্বল ও বালিশ, আসবাবপত্র, কারা হাসপাতালের ঔষধ, হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি) কোটি কোটি টাকার সরকারী ক্রয়ের ক্রয়কমিটির সভাপতি হিসেবে গত দুই বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। তার নেতৃত্ব তৈরী হয়েছে কারা অধিদপ্তর কেন্দ্রিক এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করতো কারা অধিদপ্তরের সব নিয়োগ এবং ক্রয় সংক্রান্ত সকল বিষয়।

কারাবিধি মোতাবেক কারাক্ষিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্ব বিভাগের কারা উপ মহাপরিদর্শকগণ দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও পূর্ববর্তী সরকার তাদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে কারারক্ষি নিয়োগ সহ ৩য় শ্রেণীর সকল নিয়োগ কারা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। নিয়োগ কমিটির প্রধান বা সভাপতি করা হয় অতিরিক্ত কারা মহা পরিদর্শককে এবং সদস্য সচিব করা হয় সহকারী কারা মহা পরিদর্শক( প্রশাসন) কে।

এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট প্রধান হয়ে উঠেন কর্ণেল শেখ সুজা।তার প্রধান সহযোগী ছিলেন সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া।

কারা অধিদপ্তর মূলত তৃতীয় ও চতূর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদান করে। সম্প্রতি আউটসোর্সিং এর মাধ্যমেও কিছু জনবল নিয়োগের দায়িত্ব কারা অধিদপ্তরের রয়েছে। কারা অধিদপ্তরের এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে সীমাহীন অনিয়ম-দূর্নীতির নজীর গড়েছেন শেখ সুজাউর রহমান।

গোপালগঞ্জের মানুষ এমন পরিচয়ের সুবাদে তিনি ঘনিষ্ট হয়ে উঠেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার দপ্তরের বিভিন্ন পদপদবীর কর্মকর্তাদের সাথে। তার সাথে সুসম্পর্ক ছিল পূর্ববর্তী সুরক্ষা সেবা সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরীর সাথে। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস মনির, সহকারী কারা মহা পরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূইঁয়ার নেতৃত্বে কারা অধিদপ্তরে কর্মরত ডেপুটি জেলার রুস্তম আলী, কারা অধিদপ্তরের সদস্য সচিব এআইজি (প্রশাসন) মইনুদ্দিন ভুইয়া, ডেপুটি জেলার মো. আশরাফুল ইসলাম, ডেপুটি জেলার মুশফিকুল আলম, ডেপুটি জেলার সাইদুল ইসলাম, ডেপুটি জেলার মো.ইব্রাহিম, ডেপুটি জেলার ফয়েজুর রহমান, ডেপুটি জেলার ফেরদৌস মিয়া, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্কের পি.এ হারুনর রশিদ, অফিস সহায়ক মো. ইদ্রিস আলী, অফিস সহকারী আব্দুল মালেক , অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্কের গানম্যান কারারক্ষী নাজমুল হাসান, কারারক্ষী নং- ১৩৯৫৮ জাহিদুল আলম, কারারক্ষী নং- ১৩৯৬৪ লিমন চন্দ্র, কারারক্ষী নং- ১৪১১৩ মেহেদী হাসান, কারারক্ষী নং-৪৩১৯৭ রাফসান জানি, কারারক্ষী নং-১৩৬১০ নাজমুল হাসান, কারারক্ষী অলিউল্লাহ (ড্রাইভার), কারারক্ষী রুহুল আমিন (অডিট শাখা), কারারক্ষী নং- ১৩১৩২ মোক্তার হোসেন, কারারক্ষী নং- ১৩১৭৪ ইকবাল মাহমুদ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী শাওন, সাবেক কারা মহাপরিদর্কের গানম্যান, কারারক্ষী ইউসুফ, কারারক্ষী ও ড্রাইভার কামাল উদ্দিন, নারায়নগঞ্জ জেলা কারাগারের কারারক্ষী কারারক্ষি ইউসুফ, ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী মশিউল, কারা উপ মহাপরিদর্শক দপ্তরে কর্মরত কারারক্ষী নং-সুলতান, কারারক্ষী ও ড্রাইভার এরশাদ আলী, কারারক্ষী নং- ১৪৭৭০ হাসান ইমাম, কারারক্ষী ও ড্রাইভার- মুরাদ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী শাহিন আলম, ডেস পাস শাখার কারারক্ষী নং-রুহুল আমিন , কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষী নং-১৩৪১৯ মো. শহীদ খান, কারারক্ষী নং- ১৩০৫৮ আনোয়ার, কারারক্ষী নং-১৪৬১০ আজিজুল ইসলাম, কারারক্ষী নং- ১৪৩১৫ মাসুদ রানা ও তার বাসায় কর্মরত কারারক্ষি হাফিজ প্রমূখকে নিয়ে গড়ে তুলেন এক বিশাল সিন্ডিকেট।

এই সিন্ডেকেটের নিউক্লিয়াস ছিলো মাইন উদ্দিন ভূইঁয়ার কারা অধিদপ্তের ছয়জন ডেপুটি জেলার। এই নিয়োগ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট দুইটি কারারক্ষি ও মহিলা কারারক্ষি নিয়োগে হাতিয়ে নেয় শত কোটি টাকা।

মূলত কারা অধিদপ্তরে কারারক্ষি/ মহিলা কারারক্ষি পদে নিয়োগের জন্য ২৫ জুন ২০২৩ খ্রি. এর পত্রে প্রেক্ষিতেদদ গত ২৭ জুন ২০২৩ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ এবং The daily New Nation পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। একই সাথে কারা অধিদপ্তরের ( WWW. prison.gov.bd) ওয়েবসাইটেও বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশকালে ৩৩ টি জেলার ৩৫৫ জন পুরুষ প্রার্থী এবং ১৪ টি জেলার ১৪ জন মহিলা প্রার্থীসহ সর্বমোট ৩৬৯ জন প্রার্থীকে নিয়োগের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

উক্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে আবেদনের শর্তাবলীতে স্পষ্টত জেলা কোটা বহাল রেখে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা, আনসার-ভিডিপি কোটা, এতিম কোটা সহ ক্রমিক ৫ নং বর্ণনা মতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংক্রান্ত সরকারের সার্কূলার ও বিদ্যমান বিধি-বিধান অনুসরণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

উক্ত নিয়োগ লাভে আগ্রহী প্রার্থীদের http://Teletalk.com.bd এই ওয়েব সাইটে আবেদনপত্র পূরণের জন্য গত ১১ জুলাই ২০২৩ হতে ১০ আগষ্ট ২০২৩ পর্যন্ত একমাস সময় প্রদান করা হয়। উক্ত পদ্ধতিতে আবেদনকারীদের প্রিপেইড TeleTalk সাবক্রাইবারদের SMS এর মাধ্যমে প্রেরিত পাসওয়ার্ড ও ইউজার আইডিতে লগইন করে প্রাসঙ্গিক তথ্য সম্বলিত প্রবেশপত্র প্রিন্ট-আউট এবং পরবর্তী যাবতীয় তথ্য জানানো হবে মর্মে অবহিত করা হয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ০৯ মার্চ ২০২৪ হতে ২৮ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ১৬ দিন ব্যাপী আবেদনকারীদের মধ্যে মোট জন প্রার্থীর শারীরিক যোগ্যতা যাচাই বা স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। গত ০১ এপ্রিল ২০২৪ স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। গত ১৯ এপ্রিল ২০২৪ শারীরিক যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। গত ২৯ এপ্রিল ২০২৪ কারারক্ষি এবং মহিলা কারারক্ষি পদে লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়।লিখিত পরীক্ষায় মোট ২৪৩৩ জন পুরুষ এবং ১৫ জন মহিলা প্রার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়। সর্বমোট ২৪৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন গড়ে ১০০ জন করে (১৫ মে ২০২৪ হতে ১২ জুন ২০২৪ পর্যন্ত) এবং ১৩ জুন ২০২৪ ৪৮ জন পরীক্ষার্থীর অফিস খোলার দিনে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়।

দেশে কোটা এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে কারা অধিদপ্তর তড়িঘড়ি করে ১১ জুলাই ২০২৪ কারারক্ষি নিয়োগের চুড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে। এতে বিভিন্ন কোটাসহ মোট ৫৫৪ জন পুরুষ প্রার্থী এবং মোট ১৫ জন মহিলা প্রার্থীকে চুড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়।

লক্ষণীয় যে, ইতোপূর্বে ৩৩ জেলার মোট ৩৫৫ জনের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রচারিত হলেও চুড়ান্ত ফলাফলে ৫৫৪ জন পুরুষ প্রার্থীকে চুড়ান্তভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে পদ সংখ্যা হেরফের হতে পারে উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীতে আরো ১৯৯ জন পুরুষ এবং ১ জন মহিলা কারারক্ষির পদ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে চুড়ান্তভাবে যে অতিরিক্ত ২০০ জনকে নিয়োগের জন্য চুড়ান্ত করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী ৩৩ জেলা হতে নিয়োগের জন্য আবেদন আহবান করে বিজ্ঞপ্তি জারী করা হলেও পরবর্তী ২০০ জনের বিজ্ঞপ্তি জারী না করায় এবং ইতোমধ্যে অনলাইনে আবেদনের সময় পার হয়ে যাওয়ায় বাকী ২০০ জনকেও পূর্বের ৩৩ জেলা থেকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া করা হয়। ফলে অন্য কোন জেলার প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেননি। এটি অন্য জেলার অধিবাসীদের বঞ্চিত করায় বৈষম্য সৃষ্টি করে।

নিয়োগপ্রাপ্ত কারারক্ষীদের প্রশিক্ষনের জন্য ০৮-১০ অক্টোবর ২০২৪ এর মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশিক্ষণ একাডেমিতে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ, ২০২৩ সালে একই কমিটির মাধ্যমে ৩৮৩ জনের একটি বড় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগ নিয়েও অনেক বির্তক রয়েছে। যেখানে, সারিরিক সক্ষমতায় আনফিট, জেলা কোটা বিবেচনায় না করা, সাধারণ কোটায় বিবাহিতদের নিয়োগসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে।

সহকারী কারা মহা পরিদর্শক মাইন উদ্দিন ভূইঁয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে তার সরকারি মোবাইল নম্বরে এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান বলেন, নিয়োগের একটি নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে। যথাযথ নিয়ম নিতি মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া কাজ হয়েছে। আর এই নিয়োগের একটি কমিটি আছে। আমি সিনিয়র হিসেবে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আছি।

এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেঃ জেনাঃ সৈয়দ মোঃ মোতাহের হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পূর্বে কি হয়েছে আমি জানিনা। যদি কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে