শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

দেশে ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে! 

যাযাদি ডেস্ক
  ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০:৩৮
আপডেট  : ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০:৪০
দেশে ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে! 
প্রতীকী ছবি

এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি ধর্ষণের অভিযোগ এবং এর সহিংসতার মাত্রা দেশে নারীর নিরাপত্তার ইস্যুটিকে আবারও সামনে এনেছে। পরিস্থিতিটাকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করছেন মানবাধিকার কর্মী ও নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারিরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। খবর:বিবিসি বাংলা

গত শুক্রবার কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নারীকে ধর্ষণ এবং শনিবার সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মুরাদনগরের ঘটনার আলোচনা সমালোচনার ও বিতর্কের মধ্যে মঙ্গলবার ভোলায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে।

ভোলায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারী জানান, তার স্বামীকে আটক করে নির্যাতন চালিয়ে অর্থ আদায়ের জন্য ডেকে নেওয়ার পর তাকে নির্যাতন করেন।

তিনি আরো বলেন ‌'হেগো পা ধরছি যে ভাই আমনেরা আমার লগে এই কাজ কইরেন না। আমনেগো ছোড বইনের মতো কিন্তু হেরা মানে নাই। আমার লগে অত্যাচার করছে। এইডা হওয়ার পর আমার বাইচে থাকার কোনো ইচ্ছাই আর ছিল না। আমি দুইবার গেছিলাম আত্মহত্যা করতে আমি পারি নাই।'

এর আগে কুমিল্লার মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারীকে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে মারপিট করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী নারীকে পরিবারের সামনে বিবস্ত্র অবস্থায় ভিডিও করা হয়। ঘটনার পর ভুক্তভোগী পরিবারটি এলাকা ছাড়ার চেষ্টা করে।

মুরাদনগরে ভুক্তভোগীর মায়ের সামনে ওই ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ‌'এখন আমরা বিচার চাই। বদনাম না এইডা? এতে তো মইরা যাওনের কথা। এই দুনিয়ায় না থাইকা তো মইরা যাওনের কথা। মুখ দেহানোর কথা?'

কুমিল্লার মুরাদনগরের পরিবারটি সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিজের কনভেনর লাকী বাছাড়।

তিনি বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিষয়গুলো আমরা দেখতে পেলাম, সেটা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং ঘটনাটা আমাদের সংখ্যালঘুদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আরও পড়ে যাচ্ছি দিনে দিনে।'

পরিস্থিতি নিয়ে মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, 'সংখ্যালঘুদের যে ঘটনাগুলো ধর্ষণসহ ঘটছে, এগুলো কিন্তু ভয়াবহ।'

লাকী বাছাড় বলেন, বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে তাদের হিসাব হলো কুমিল্লায় এ বছর মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে অন্তত ১২টি ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। এছাড়া পাঁচই অগাস্টের পর থেকে ৩০০টি ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

তিনি আরো বলেন, ‌'গত পাঁচই আগস্টের পর থেকে আমাদের কাছে ৩০০-এরও অধিক ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের যে কেইসগুলো আসছে, যেটা আমরা হাইকোর্টে একটা রিট দায়ের করার চেষ্টা করতেছি যে ধর্ষকদের যেন প্রকৃত সাজা দেওয়া হয়। অধিকাংশ থানাগুলো থেকে যখন আমরা সঠিক তথ্যগুলো নেওয়ার চেষ্টা করছি, সেখানে বেশি প্রমাণিত হচ্ছে প্রশাসনের কিছুটা নেগলিজেন্সি আছে।'

ভোলা এবং কুমিল্লার ঘটনায় অভিযুক্ত আসামিদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ বৃদ্ধির কারণে মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলীর পর্যবেক্ষণে ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় খারাপ।

তিনি বলেন, 'আমরা যারা হিউম্যান রাইটস নিয়ে কাজ করি, আমরা যারা এতদিন ধরে রুল অব ল, আইনের শাসনের কথা বলি, পরিবর্তনটা চাচ্ছিলাম। আমরা কিন্তু ছাত্রদের সঙ্গে ছিলাম। কারণ বিচারহীনতা থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ঘটনা ঘটছিল আগের সরকারের সময়। যার জন্য আমরা পরিবর্তন চাচ্ছিলাম। এখনতো আরও ভয়াবহ অবস্থা।'

হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিজের কনভেনর লাকী বাছাড় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'দিনে দিনে ধর্ষণের ঘটনা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে এবং রিসেন্টলি আপনারা হয়তো দেখতে পাচ্ছেন যে অনেক মা বোনদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। যেগুলোর সঠিক কারণটা আমরা জানি না যে উনাদের এই লাশগুলো কী কারণে বা তাদের মৃত্যুর কারণটা কী?'

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে, এ বছরের ছয় মাসে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই সংখ্যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া গত ছয় মাসে দেড়শর বেশি ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, ২০২৪ সালে মোট ৪০১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর এ বছর ছয় মাসের মধ্যেই এ সংখ্যা ৪৪১টি।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, নারীর প্রতি সহিংতার চার ভাগের একভাগও মিডিয়ায় আসে না। কেবল আলোচিত এবং গ্যাং রেপের মতো ঘটনাগুলো সামনে আসে। তারপরে অপরাধীরা যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে কিন্তু সেই খবরটাও লোকাল মিডিয়া দিতে পারছে না।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১১ মাসে সহিংসতা ও ধর্ষণের ৭৮০টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৫৮টি ঘটনা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।

ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, 'খুবই উদ্বেগজনক ধর্ষণের চিত্র, নারী নির্যাতনের চিত্র। সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন সার্বিকভাবে বেড়ে চলছে এবং উদ্বেগজনভাবে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে না। আমাদের উদ্বেগটা এটাই। রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়ছে না।'

বাংলাদেশে পাঁচই অগাস্টের পর থেকে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। গণআন্দোলনে সর্বস্তরে নারী উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্ত নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী এবং সহিংসতা ও ধর্ষনের ঘটনা বৃদ্ধি মানবাধিকারকর্মীদের আশাহত করেছে।

সাইদুর রহমানের পর্যবেক্ষণ হলো, আগষ্ট পরবর্তী বাংলাদেশে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী নেতিবাচক। এছাড়া মব এবং কট্টর চিন্তাধারায় নারীকে কোণঠাসা করার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।

সাইদুর রহমান বলেন, 'মেয়েরা ভয় পাবে। রাতে বের হওয়া যাবে না। সন্ধ্যায় বের হওয়া যাবে না। বোরকা ছাড়া বের হওয়া যাবে না। এইটা চায় তারা। এইটার জন্য এইগুলো দৃষ্টান্ত তৈরি করতেছে তারা। তাদের কথা না শুনলে কী হয়। লাথি মারবে, বেল্ট দিয়ে পেটাবে। যদিও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।আবার তাকে ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেছে। এই কাজ করার জন্য সে হিরো হয়ে যাচ্ছে।'

এই মানবাধিইকার কর্মী প্রশ্ন করেন, ‌'সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে, আমরা কী কালচার চেঞ্জ করলাম?'

সম্প্রতি ভোলা ও কুমিল্লায় ধর্ষণের দুটি ঘটনায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। ভোলার ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠায় বিএনপির শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনের তিনজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

সালমা আলী বলেন, 'মনে হচ্ছে আমরা কোনো হিংস্র একটা জঙ্গলে বাস করছি। আমরা দেখতে চাই, সরকার কীভাবে অ্যাড্রেস করছে। পলিটিক্যাল পার্টি বা যারা ভোট চান, তাদের কাছ থেকে শুনতে চাই, তারা কীভাবে এই জায়গাটা নিয়ন্ত্রণ করবে।'

নারীর প্রতি সহিংসতা বিশেষ করে ধর্ষণের মতো ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ সবসময়ের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় নাজুক হিসেবেই দেখছেন নারী ও মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে