বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে

শিমুল বিশ্বাস
  ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১৭:৪৪
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে

বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম ও ঘামের ওপর। কৃষি উৎপাদন, প্রবাসী রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টস শ্রমিকরাই সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আরো স্পষ্ট করে বললে তুলনামূলক স্বল্প শিক্ষিত মেহনতি মানুষই বাংলাদেশের আর্থিক খাতের প্রাণ শক্তি। আর মধ্য ও উচ্চশিক্ষিত বিরাট এক জেনারেশন এ দেশে বেকার! কিন্তু দুর্ভাগ্য, যাদের পরিশ্রমে রক্ত আর ঘামে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে তারা আজ অধিকার থেকে বঞ্চিত। নায্য প্রাপ্যটা পাওয়ার জন্য রাজপথে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান পরবর্তী বাংলাদেশে এখনো শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস অনেক উজ্জ্বল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন বড় ভ‚মিকা রেখেছে। ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিক শ্রেণি শুধু নিজের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে থাকে। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থাননেও শ্রমিক-কর্মচারীরা জোটবদ্ধ হয়ে (স্কপ) ছাত্র জনতার সঙ্গে মিলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে লড়াই করে রক্ত ঝরিয়েছে। স্বৈরাচারের পতন, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীরা বারবার রক্ত ঝরিয়েছে। কলকারখানা ও অফিস ছেড়ে শ্রমিকরা রাজপথে নেমে এসেছে। অধিকারের প্রশ্নে ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিক শ্রেণি যুগে যুগে আপসহীন।

সত্তরের দশকে গাজীপুরের টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের আদমজী, খুলনার খালিশপুর, যশোহরের নোয়াপাড়া আর চট্টগ্রামের শ্রমিক আন্দোলন এ দেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল।

জনগণের অতীত ত্যাগকে কালিমালিপ্ত করেছে আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা, বিজ্ঞান, জ্ঞানচর্চা ও চিরাচরিত সহঅবস্থানের ধারা বিনাশ করেছে এবং অফিস, প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় শ্রমিক অন্দোলনের টুটি চেপে ধরে রেখেছে। ছাত্রসমাজ ও শ্রমিক শ্রেণি জেগে উঠলে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস লেখা সম্ভব। অলরেডি শ্রমিকরা নতুন উদ্যমে সংগঠিত ও স্বোচ্ছার হয়েছে। গার্মেন্টস, পরিবহণসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার নিয়ে মাঠে নামছে।

আওয়ামী লীগ সমর্থক শ্রমিক লীগ সরকারি ক্ষমতা ও পেশিশক্তির জোরে অবৈধ ও অনৈতিকভাবে সিবিএ নির্বাচিত হয়ে শ্রমিক দলের অন্তর্ভুক্ত বেসিক ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের গণহারে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে হয়রানিমূলক বদলি শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দল সমর্থক শ্রমিক-কর্মচারীদের বরাদ্দকৃত বাসা বাতিল করে তাদের বাস্তচ্যুত করে। বিরোধীদলীয় সমর্থক শ্রমিক-কর্মচারীদের ঘন ঘন হয়রানিমূলক বদলির ফলে শ্রমিক নেতাদের সন্তানদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।

মিরপুর, গাজীপুর, ভালুকা, নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামের শ্রমিক শ্রেণি জেগে উঠলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধির বাজারে শ্রমিকদের বর্তমান বেতনে জীবনযাপন বড়ই কঠিন হয়ে গেছে। এই অবস্থার অবসানের জন্য লড়াই করে তারা চাকরি হারাচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, মার খাচ্ছে।

বাংলাদেশে শ্রম আইন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাÐ পরিচালনা ও সভা সমাবেশে অংশগ্রহণের অধিকার থাকলেও শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণের কারণে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের অনেক নেতাকে পুলিশ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলার ফলে তারা চাকরি হতে বরখাস্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলা আওয়ামী জামানায় এখন অপরাধের পর্যায়ে চলে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা ও দেশের সুনাম অর্জনকারী গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকরা নায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে আঞ্জুয়ারা খাতুন, রাসেল হাওলাদার, জালাল উদ্দীন ও ইমরান রাজপথে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

এত স্বপ্ন ভঙ্গ আর হতাশার মধ্যে আশার দিক হচ্ছে গণতন্ত্রকামী জনতার পাশাপাশি শ্রমিকরা আবার সংগঠিত হচ্ছে। শ্রমিক শ্রেণি সংগঠিত প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের কথা বলছে। রাস্তায় নামছে। রক্ত ও জীবন দিতেও পিছপা হচ্ছে না। শ্রমিক শ্রেণি নতুন ইতিহাস লেখার রসদ জোগাচ্ছে। নব উদ্যমে আন্দোলন ও সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করছে। শ্রমিকদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে দেশ ও বিদেশের গণতান্তিক শক্তি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিক অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন। শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে, নির্যাতন করলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওয়াজ উঠছে। বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী কল্পনা আক্তারের নাম উল্লেখ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও বিদেশ সচিব এন্টনি বিøংকেন কথা বলছেন। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের অধিকারবঞ্চিত শ্রমিক আন্দোলনে নতুন আশার দিক। শ্রমিক শ্রেণির সাংগঠনিক ও সমষ্টিগত লড়াই সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। শ্রমিকরা সাহস পাচ্ছে, সংগঠিত হচ্ছে, রাস্তায় নামছে শুধু বেতনের জন্য নয়, দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও। স¤প্রতি ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ৪০ বছর পর ২১টি শ্রমিক সংগঠন ‘জাতীয় শ্রমিক-কর্মচারী কনভেনশনে’ মিলিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন গডে তোলার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।

এই দুঃসময়ে দরদি রাজনীতির পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক আর ছাত্র আন্দোলনই পারে বাংলাদেশকে মুক্তির পথ দেখাতে। দেশে এখন কৃষক আন্দোলন নেই, এই সুযোগে সরকার অত্যাবশ্যকীয় পরিশেবা বিলের মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনের হাতে পায়ে বেড়ি পরাতে চায়। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে শ্রমিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখায়। নিজেদের অধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনেও শ্রমিক আন্দোলন অনেক বেশি প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন পদক্ষেপ শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার পেতে সহায়ক হবে। নতুন দিনের সূচনা করতে শ্রমিক আন্দোলন অতীতের মতো ভবিষ্যতেও নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। শ্রমিকদের মুক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তির জন্য শ্রমিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী।

যাযাদি/এসএস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে