বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২
পহেলা বৈশাখ

মঙ্গল শোভাযাত্রা বনাম আনন্দ শোভাযাত্রার বাস্তবতা

মু. জোবায়েদ মল্লিক বুলবুল
  ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:৩৫
আপডেট  : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:৪৪
মঙ্গল শোভাযাত্রা বনাম আনন্দ শোভাযাত্রার বাস্তবতা
ছবি: যায়যায়দিন

পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ, বাঙালির প্রাণের উৎসব। এটি শুধুমাত্র একটি নতুন বছরের সূচনা নয় বরং এটি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাম্যের প্রতীক এবং জাতীয় ঐক্যের মেলবন্ধন। পহেলা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিন, বছরের সকল ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে নতুন আশায় বুক বাঁধার এক অনন্য মুহূর্ত। এই দিনে বাঙালি জাতি ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণিভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে উদযাপন করে বাঙালিত্বের জয়গান। এই দিনটি উদযাপন করতে সারাদেশে নানা রকম অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ঘটা করে পান্তা-ইলিশ খাওয়া হয়।

বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদ ও মনীষীদের নানা মত রয়েপহেলা ছে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, স¤্রাট আকবরের আমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। তখন হিজরি সন অনুসারে কৃষিকাজ বা ফসলের সময় নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল- কারণ হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল। তাই কৃষিনির্ভর এতদাঞ্চলের বাস্তবতা অনুযায়ী সৌরভিত্তিক বাংলা সনের সূচনা ঘটে। ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রিস্টীয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়- যা ছিল স¤্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন। তবে ১৫৮৪ সালের ১০/১১ মার্চে বাংলা সন বা ফসলি সন হিসেবে এটি কার্যকর হয়।

‘বাংলা নববষর্’ বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ। এ দিনটি ঘিরে আমাদের এ ব-দ্বীপে যে উৎসবের আবহ সৃষ্টি হয়- তা সারা বছরের একঘেয়েমি দূর করে আনে প্রাণের সজীবতা। পহেলা বৈশাখে পুরাতন বছরের দেনা-পাওনা চুকিয়ে নতুন হিসাব খাতা খোলার রেওয়াজ রয়েছে- যাকে হালখাতা বলা হয়। দোকানদাররা এ উপলক্ষে তাদের গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করান, সম্পর্ক দৃঢ় করেন। এটি শুধু ব্যবসায়িক দিক নয় বরং সামাজিক সৌহার্দ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

প্রতিবার নতুন বছর নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। পুরাতন বছরের ভুল-ব্যর্থতা ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নববর্ষে গ্রহণ করা হয়। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রে এই নব সূচনা একটি নতুন চেতনার বার্তা নিয়ে আসে। কিন্তু প্রতিবারই এ উৎসবে কিছু নেতিবাচক প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। অতিরিক্ত ভোগবিলাস, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, কিছু ক্ষেত্রে অশালীন আচরণ ইত্যাদি। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে বৈশাখের শোভাযাত্রাটির নাম কি হবে- তা নিয়ে। কেউ বলছেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’, আবার কেউ কউে বলছেন মঙ্গল শোভাযাত্রায় হিন্দুত্ববাদের বা ভারতের চাপিয়ে দেওয়া রেওয়াজ রয়েছে তাই ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ হলে ভালো হয়। এগুলো বাংলা নববর্ষের মূল চেতনাকে আঘাত করে। তাই আমাদের উচিত উৎসবকে সঠিকভাবে, শালীনতার সঙ্গে উপভোগ করা এবং নতুন প্রজন্মকে প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করানো। যদিও উৎসব তো উৎসবই, শোভাযাত্রাও তো উৎসবেরই অংশ- হোক সেটা মঙ্গল শোভাযাত্রা বা আনন্দ শোভাযাত্রা নামে, কী আসে-যায়! কিন্তু নামের মিল থাকলেও এ দুটির উদ্দেশ্য, প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।

১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ (তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট) পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রার সূচনা হয়েছিল। শুরুতে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। তারও আগে ১৯৮৫ সালে যশোরে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম ছিল। যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা শুরু হয়। ২০২১ ও ২০২২ সালে মতান্তরে ১৯৯০ সালে সঙ্গীতশিল্পী ওয়াহিদুল হক এবং ভাষা সৈনিক এমদাদ হোসেনের প্রস্তাবে আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা রাখা হয়। নববর্ষের শোভাযাত্রা মূলত একটি প্রতীকী শোভাযাত্রা- যার মাধ্যমে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, মানবতা এবং সংস্কৃতির চর্চাকে তুলে ধরা হয়। শোভাযাত্রাটিতে নানা রকম বিশালাকৃতির মুখোশ, পশুপাখির প্রতিকৃতি, লোকজ উপাদান ও নানা রঙের ব্যানার বহন করা হয়। এগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়- যেমন মুখোশ অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করার প্রতীক, ঘোড়া বা হাতি জাতিগত শক্তি ও গৌরবের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ২০১৭ সালে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়- যা এই শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকেও প্রমাণ করে।

অন্যদিকে, আনন্দ শোভাযাত্রা মূলত একটি আনন্দমুখর সামাজিক আয়োজন। এটি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্থানীয় কমিউনিটি বা সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত হয়। আনন্দ শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ হলো নববর্ষের আনন্দ ভাগাভাগি করা, ঐতিহ্য তুলে ধরা এবং সামগ্রিকভাবে উৎসবের রঙে মানুষকে রাঙিয়ে তোলা। এতে লোকজ গানে নাচ, ঢাকঢোল, পাঞ্জাবি-পাজামা বা শাড়িতে সজ্জিত মানুষ অংশ নেয়। তারা দলবেঁধে গান গেয়ে, হাসিমুখে, নানা সাজসজ্জায় শোভাযাত্রা করে। চট্টগ্রামে ঐতিহাসিকভাবে স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ বের করে। সেখানে থাকে বর্ণাঢ্য সাজসজ্জা ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন।

সুতরাং ভিন্ন নামীয় এ দুটি অনুষঙ্গের মূল পার্থক্য আমরা বাস্তবতার নিরিখে নি¤œভাবে বর্ণনা করতে পারি:

১. উদ্দেশ্য: মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি প্রতীকী ও আদর্শনির্ভর শোভাযাত্রা- যেখানে শুভ শক্তির বিজয়ের বার্তা থাকে। অন্যদিকে আনন্দ শোভাযাত্রা মূলত উৎসবমুখর এবং আনন্দ ভাগাভাগির উদ্দেশে আয়োজিত।

২. উৎপত্তি ও স্বীকৃতি: মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা অনুষদ কেন্দ্রিক এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত; আনন্দ শোভাযাত্রা স্থানীয় ও সাংগঠনিক উদ্যোগে পরিচালিত।

৩. উপাদান: মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ, প্রতীকী পুতুল, ব্যানার প্রাধান্য পায়। আনন্দ শোভাযাত্রায় থাকে লোকগান, নৃত্য ও উৎসবের পরিবেশ।

পহেলা বৈশাখে এই দুটি শোভাযাত্রা ভিন্নধর্মী হলেও একটি অন্যটির পরিপূরক বলেই মনেকরি। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনাকে জাগ্রত করে আর আনন্দ শোভাযাত্রা আমাদের উৎসবমুখরতা ও মিলনমেলার প্রতিচ্ছবি।

বাংলা নববর্ষ উদযাপনের রীতি শহর ও গ্রাম দুই জায়গাতেই রয়েছে। ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে বৈশাখ উপলক্ষে মেলা বসে। মেলায় নানা রকম হস্তশিল্প, খেলনা, মিষ্টান্ন, গান-বাজনা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা সব মিলিয়ে এক অন্যরকম আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। লোকজ সংস্কৃতির এই আবহ সমাজে একটি আন্তরিক- পারিবারিক বন্ধন গড়ে তোলে। এদিনে খাদ্য ও পোশাকেও অনেক ভিন্নতা ও বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। সকালে ভাপা পিঠা, চিতই, নাড়–, সেমাই, মুড়ি-চিনি খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে হোটেল-রেস্তোরাঁয় বা দলবেঁধে ঘটা করে পান্তা-ইলিশ খাওয়া যেন একটি প্রচলিত প্রথায় রূপ নিয়েছে। যদিও পান্তা-ইলিশ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে- তবুও এর মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি মানুষের টান প্রকাশ পায়। এছাড়া পহেলা বৈশাখে ছেলেরা সাধারণত পাঞ্জাবি-পাজামা পরে আর মেয়েরা পরে শাড়ি, মাথায় ফুলের মালা। লাল-সাদা রঙ যেন হয়ে উঠে নববর্ষের প্রধান রঙ।

বাংলা নববর্ষ কোনো সম্প্রদায়ের নয় বাঙালির হৃদয়ের এক অনন্য আবেগ। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের-বর্ণের মানুষ মিলেমিশে আসুন এই দিনটি উদযাপন করি। আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহন হয়ে উঠুক এবারের নববর্ষ। এর মাধ্যমে ফুটে উঠুক আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও উদার মানসিকতা। বাংলা নববর্ষ গোটা বাঙালি জাতির সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠুক- এটাই প্রত্যাশা। শুভ বাংলা নববর্ষ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট

যাযাদি/ এমএস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে