৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের সকল নারীর অবদানকে সম্মান জানানো তাঁদের অর্জন উদযাপন করা এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ দিনটিকে শুধুমাত্র উদযাপনের জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের উচিত নারীদের জীবনে অর্থবহ পরিবর্তন আনার জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা। সেই পরিবর্তন যদি এমন কোনো খাতে আসে যা তাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত তাহলে তা আরও কার্যকরী হবে।
এক্ষেত্রে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে নারীর ক্ষমতায়ন, জ্বালানি অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই যা নারী দিবসের আলোচনায় নতুন এক মাত্রা যোগ করবে।
নারী দিবসের এই দিনে আমাদের প্রথমত লক্ষ্য রাখতে হবে যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের প্রতি নারীর অংশগ্রহণ এখনো যথেষ্ট পর্যাপ্ত নয়। এই খাতে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বর্তমান সমাজে বিশেষত গ্রামীণ বাংলাদেশে নারী নিজস্ব কাজকর্মে আবদ্ধ থাকেন এবং পুরুষদের তুলনায় তাঁদের কাজের সুযোগও সীমিত থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় নারীর যোগদান শুধু খাতের উন্নতির জন্য নয় বরং তাঁর নিজস্ব জীবনমান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।
জ্বালানি উৎপাদন, বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সচেতনতা এবং নীতিগত উদ্যোগগুলি গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সরকার নারীদের প্রযুক্তিগত দিক থেকে দক্ষ করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে যার ফলে নারীরা বিদ্যুৎ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। যেমন, অনেক নারী এখন বায়োগ্যাস, সৌর শক্তি এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করছেন। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে নারীরা শুধু চাকরি পেতে সক্ষম হচ্ছেন না বরং তাঁরা তাঁদের সমাজে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হচ্ছেন। তবে নারীদের ক্ষমতায়ন শুধু প্রশিক্ষণ বা চাকরি পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সমাজের প্রতি তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি এবং তাঁদের উন্নয়নের জন্য সমতাবাদী মনোভাব গ্রহণের ফলস্বরূপ। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নারীদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, এবং তাদের নেতৃত্বের সুযোগ প্রদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নারীর জ্বালানি অধিকার শুধুমাত্র একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে নয় বরং এটি তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের গুণগত মান এবং নিরাপত্তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নারীরা সাধারণত গৃহস্থালি কাজের জন্য কম দামে পাওয়া, খরচ সাশ্রয়ী, অথবা অস্বাস্থ্যকর জ্বালানি ব্যবহারের মুখোমুখি হন। যেমন, সলিড ফুয়েল (কাঠ, গোবর, পটাসিয়াম ইত্যাদি) ব্যবহার নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দীর্ঘ সময় ধরে এসব জ্বালানি ব্যবহারের কারণে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, চোখের রোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া বিদ্যুতের অভাবও নারীদের জীবনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সন্ধ্যা হলেই নারীরা অন্ধকারে পড়েন যা তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। অপরিচিত মানুষের আক্রমণ বা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এই বাস্তবতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি নারীদের জন্য বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।
তবে, শুধু নিরাপত্তার দিক নয় সঠিক জ্বালানি ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীদের জীবনমানও উন্নত করা সম্ভব। আজকের দিনে সৌর শক্তি, বায়োগ্যাস এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী, এবং পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। এসব প্রযুক্তি নারীদের সময়, শ্রম এবং অর্থ সাশ্রয় করতে সহায়তা করবে পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে।
জ্বালানি খাতে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের ভূমিকা অপরিসীম। সরকার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্থাপন, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং এই খাতে নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে পারে। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নারীদের জন্য সুশৃঙ্খল কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া উচিত। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের সহযোগিতা ও ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট প্রদান করা হলে তারা জ্বালানি খাতে তাঁদের ব্যবসা পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। সরকার যদি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে তাহলে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে যা তাদের অধিকার এবং আত্মমর্যাদার প্রতিফলন ঘটাবে।
জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলগুলির মধ্যে 'এনার্জি ফর অল' (সকলের জন্য শক্তি) এবং 'লিঙ্গ সমতা' অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি লক্ষ্য একে অপরকে পরিপূরক করে। পৃথিবীর প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত যার মধ্যে অনেকাংশই নারী। একইভাবে, নারীদের সঠিক জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত না হলে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যগুলো অর্জন কঠিন হবে। তাই, নারী দিবসে আমাদের এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিত এবং এই খাতে নারীদের ক্ষমতায়নকে একটি অগ্রগামী পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
নারী দিবসে আমরা যদি সত্যিকার অর্থে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং অধিকার নিশ্চিত করতে চাই তবে আমাদের এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং তাঁদের জন্য সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব শক্তির ব্যবস্থা করা এর মাধ্যমে আমরা নারীর জীবনমান উন্নয়ন এবং সমাজের উন্নতি সাধন করতে পারব। সুতরাং, এই নারী দিবসে আমাদের প্রত্যাশা হোক যে, নারীজীবনের নানা ক্ষেত্রে বিশেষত জ্বালানি খাতে তাঁদের যথাযোগ্য জায়গা এবং অধিকার নিশ্চিতে রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণ সবাই একযোগে কাজ করবে।
লেখক : এমফিল গবেষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
যাযাদি/ এসএম