কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যে আপনার প্রতিদিনের জীবনটা প্লাস্টিকে মোড়ানো?
২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবস আমাদের এই পুরনো সমস্যার দিকে নতুন করে আঙুল তুলছে। "প্লাস্টিক দূষণ আর নয়
বন্ধ করার এখনি সময়" (Beat Plastic Pollution) স্লোগান নিয়ে দিবসটির আয়োজক হিসেবে কাজ করছে দক্ষিণ কোরিয়া।
বাংলাদেশ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক দ্রব্যের বাজার। এখানে প্লাস্টিক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ৪০ হাজার কোটি টাকার এবং উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪ হাজার। যার শতভাগ কঞ্জিউমার বাংলাদেশ নিজেই। Towards a Multisectoral Action Plan for Sustainable Plastic Management in Bangladesh এর প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি, যা গত ১৫ বছরে (২০২০ সালে) বেড়ে ৯ কেজিতে দাঁড়িয়েছে! ঢাকার অবস্থা তো আরও খারাপ, যেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার মাথাপিছু ২৪ কেজি! শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিত্যক্ত হয়ে নালা, ড্রেন, পুকুর বা ডোবায় গিয়ে জমা হচ্ছে।
এই প্লাস্টিকগুলোর শেষ গন্তব্য কোথায় ভাবুন তো? আমাদের প্রিয় বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলীর বুকে, কৃষি জমিতে, আর সাগরে। প্লাস্টিকের ধরন এবং পরিবেশগত অবস্থার ওপর নির্ভর করে এটি পচতে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। কিছু প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে তো ১০০০ বছর পর্যন্তও লেগে যেতে পারে। প্লাস্টিক কণা, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক (৫ মিমি এর কম আকারের প্লাস্টিক), মাটির ভৌত গঠন পরিবর্তন করে। এটি মাটির কণিকাগুলির মধ্যে ফাঁকা স্থান পূরণ করে দেয়, যা মাটির বায়ুসঞ্চালন (aeration) এবং পানি নিষ্কাশন (drainage) ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্লাস্টিক যখন ক্ষয় হয়, তখন বিসফেনল-এ (BPA), ফথেলেটস (phthalates), ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা ইত্যাদি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে ও পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিষাক্ত পদার্থগুলো মাটি ও ফসলের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে, যা শেষ পর্যন্ত মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে (যেমন: ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ)।
Source: "Harmful Effects of Plastics on Human Health and the Environment: A Review" (ResearchGate)প্লাস্টিক দূষণ রোধে আমাদের দেশে অনেক উদ্যোগ আছে, তবে পথটা বন্ধুর। বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট (National Action Plan for Sustainable Plastic Management) এর লক্ষ্যমাত্রা আনুযায়ী, সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০% প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০% একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (Single-Use Plastic) পর্যায়ক্রমে বাদ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে। উদ্যোগটা দারুন, কিন্তু বিক্রি কমাতে প্লাস্টিক পণ্যের ভ্যাট আরো বাড়ানো প্রয়োজন এবং মাঝেমধ্যে লুকিয়ে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
প্রয়োজনে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মনে আছে? বেশ জোরেশোরে আইনের প্রয়োগ চলেছিলো। কিন্তু ২৩ বছর পর আবার বেড়েছে পলিব্যাগের ব্যবহার। এক্ষেত্রে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আরও কঠোর হতে হবে। আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ "কচ্ছপ গতিতে" হলে কিন্তু আমরা হেরে যাবো। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে বর্জ্য সংগ্রহ ও পৃথকীকরণের আধুনিক ব্যবস্থা জরুরি। বাড়িতে এবং কমিউনিটিতে পচনশীল আর অপচনশীল বর্জ্য আলাদা করার অভ্যাস তৈরী করতে হবে।
সরকারী উদ্যোগের সাথে বেসরকারি সংস্থা (NGO) গুলো পাশে আছে, তবে আরো একটু সহায়তা চাই! World Vision Bangladesh এর মতো আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো শুধু শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষাতেও কাজ করছে। তাদের Five Zero Plus পরিকল্পনায় প্লাস্টিক দূষণকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে, যা প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করছে। YPSA, Cordaid-এর মতো সংস্থাগুলো স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি খাতের সাথে মিলে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারে সাহায্য করছে। যারা প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করছে, তাদেরও এর পুনর্ব্যবহারের দায়িত্ব নিতে হবে। PRAN-RFL, Bengal Polymer-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করছে, যা প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশ সরকার পাটজাত মোড়ক ব্যবহার আইন ২০১০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্লাস্টিকের বিকল্প প্রচারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এই আইনের অধীনে ছয়টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার এবং চিনি) প্যাকেজিংয়ের জন্য পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরবর্তীতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এই আইনের আওতা আরও ১১টি পণ্যে সম্প্রসারিত করা হয়েছে।
এই পদক্ষেপ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে এবং পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের প্রচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে দেশের সব সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সুপারশপগুলোতে এখন প্লাস্টিক ব্যাগের বদলে কাগজের, কাপড়ের বা পাটের ব্যাগ ব্যবহার করছে। সবকিছুরই একটা রূপান্তরের সুযোগ থাকে, প্লাস্টিকেরও তাই। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার করে নতুন শিল্প এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। ভাবুন তো, যদি প্লাস্টিক ওয়েস্টেজ থেকে সুন্দর আসবাবপত্র তৈরি হয়? বা রাস্তা তৈরির কাজে লাগে? ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে প্রতি বছর ৩৬৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য তৈরি করা সম্ভব! বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্লাস্টিক দূষণ চুক্তি (Global Plastic Pollution Treaty) সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করে প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা পেতে পারে। বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানীরা প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন বা পরিবেশবান্ধব বিকল্প তৈরিতে গবেষণা করছেন।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫ শুধুই একটি তারিখ নয়, এটি একটি বার্তা। Ending Plastic Pollution "প্লাস্টিক দূষণ আর নয় " - এই প্রতিপাদ্য কেবল স্লোগান হয়ে থাকলে চলবে না। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অভ্যাস বদলই এই লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করবে। সাধারণ মানুষ হিসেবে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় আমাদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি: যেমন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ( স্ট্র, বোতল) এর ব্যবহার কমানো, বাজারের পলিব্যাগের পরিবর্তে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা, এবং প্লাস্টিকের বোতলের বদলে ধাতব বা কাঁচের বোতল ব্যবহার করা। প্লাস্টিকের পাত্র বা বোতল ফেলে না দিয়ে পুনরায় ব্যবহার করতে পারি, আর খাবার সংরক্ষণেও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পাত্র বেছে নিতে পারি। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পণ্য (যেমন: বাঁশ, মাটি, কাঁচ, ধাতব পণ্য) ব্যবহার করতে পারি।
প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিক উপায়ে পৃথক করে রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহারের জন্য ফেলা উচিত। এলাকার বর্জ্য সংগ্রহকারীদেরও এতে উৎসাহিত করা জরুরি। এছাড়া, পরিবার, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি, পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন ও প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করাও প্রয়োজন।
আজ থেকেই শুরু হোক । প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাই, পুনর্ব্যবহারে উৎসাহিত হই, আর পরিবেশবান্ধব বিকল্প খুঁজি। RRR-Reduce,Reuse, Recycle। মনে রাখবেন, পৃথিবী আমাদেরই ঘর, আর ঘর পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও আমাদেরই। চলুন, এমন এক ভবিষ্যৎ গড়ি, যেখানে প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশের চ্যালেঞ্জ বা বোঝা হয়ে না থেকে শুধু বইয়ের পাতার পুরোনো গল্প হয়ে থাকবে।
লেখক:
মো. কওনান মুরসালিন
টেকনিকাল স্পেশালিস্ট- কমিউনিকেশন এন্ড এডভোকেসী