সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য ঘোষণার খবরে বিএনপির অভ্যন্তরে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নেতাকর্মীদের একটি অংশ ব্যাপক উচ্ছ্বসিত হলেও অপর অংশ একে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে ভাবছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিননির্ভর হয়ে বড় ধাক্কা খাওয়ায় এখন আর পূর্বের অবস্থানে থাকতে চায় না তারা। এবার নিজের শক্তির ওপর বেশি জোর দিতে চায় দলটি।
মঙ্গলবার মার্কিন ঘোষণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ নিয়ে এখনই আশাবাদী হতে চায় না তারা। এর কারণ, নির্বাচনের আগের দুই বছর মার্কিননির্ভরতা দলকে অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে।
বিএনপির ্স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, নির্বাচন নিয়ে মার্কিনীরা যেভাবে তৎপর ছিল, এতে বিএনপির আশাবাদী না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সময় আন্দোলনের বিষয়ে কোনো পরামর্শ পায়নি তারা। ফলে একরকম বিনা বাধায় নির্বাচন সম্পন্ন করে ফের ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য শুধু বিদেশিদের ওপর আস্থা রাখাটা বিচক্ষণতা মনে করছেন না তারা।
সূত্রমতে, অতিমাত্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রাজনীতির গতিপথ বিএনপিকে বেশ সংকটে ফেলেছে। মার্কিনীদের চাপে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন দিবে এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসবেÑ এমন স্বপ্নে দলটি ঘোরের মধ্যে ছিল। বিদেশিনির্ভরতায় দলীয় নেতাকর্মীদের হিসাবের বাইরে রেখে বিদেশিদের ওপর ধরনা দিয়ে দল পরিচালনা হয়েছে। এর ফলে নেতাকর্মীদের একটি অংশ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আস্থাও হারিয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতার মতে, শুধু অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভরতার কারণে সরকারকে চাপে ফেলার পাঁয়তারা সফল হয়নি। কোনো রকম কার্যকর আন্দোলন গড়া সম্ভব হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, এই নির্ভরতার ফলে দলীয় কর্মী-সমর্থক ও নেতাদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করাই যায়নি।
এই নেতার মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করার পর নেতারা একে সফলতা চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ধারণা ছিল, ভিসানীতির ফলে সরকারের ওপর স্যাংশন আসবে এবং তাদের ক্ষমতায় আসার রাস্তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সরকার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের দরকার হবে না, যা করার যুক্তরাষ্ট্রই করে দিবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে ও পরে সবাইকে হতাশ হতে হয়েছে। কারণ, নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিল, তারাই বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে; সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এ জন্য বিদেশের ওপর আর আগের মতো আস্থা রাখার পক্ষে নয় দলের অনেকেই।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, শুধু বিদেশনির্ভরতা বিএনপির জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আন্দোলনের মাঠে বেশিরভাগ নেতারা আড়ালে থেকে বিদেশের দিকে তাকিয়ে ছিল। এ জন্য পরবর্তী রাজনীতিও বেশ কঠিন হয়েছে।
নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির বিদেশনির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সে সময় তা স্বীকার করেনি দলটি। ক্ষমতার জন্য বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে ক্ষমতাসীনদের এমন অভিযোগের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর আব্দুল মঈন খান বলেছিলেন, ‘বিএনপি যদি বিদেশিদের ওপর নির্ভর করত, তাহলে সারাবছর এসি রুমে বসে সিনেমা দেখতো। কিন্তু বিএনপি রাজপথে আন্দোলন করছে, সভা-সমাবেশ করছে। সারাদেশে পদযাত্রা করছে।’
বিএনপি সূত্রমতে, নির্বাচনের পর বিদেশিদের কার্যকরী কোনো উদ্যোগ না থাকায় বিএনপিকে শুধু হতাশই করেছে। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তারা। প্রতিবেশী ভারত বিরোধিতার কৌশল নেওয়ার ক্ষেত্রে একবার এগিয়ে আবার পিছিয়ে গেছে। চীনসহ পূর্বমুখী কূটনীতির দিকেও গুরুত্বের আলোচনা থাকলেও কার্যকরী কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। সবমিলিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতায় বিএনপি কোন পথে এগোবে, এ নিয়েও দলের অভ্যন্তরে নানা জটিলতা রয়েছে।
জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু‘র সফরে নতুন কোনো বার্তা আসে কিনা, তা নিয়েও আশায় ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু এই সফরে আশা সফল হওয়ার মতো কোনো বিষয় দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন নেতাকর্মীরা। তাই সর্বশেষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার খবরে দলের সবাই আশাবাদী হতে পারছে না।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজিজের নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় নেতাকর্মীদের খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এটি আরেকটি বিভ্রান্তি। র্যাব ও পুলিশের ৯ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। সরকারের পতন হয়নি। সরকার পতনে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নিজের শক্তি নিয়েই তাদের পরাজিত করতে হবে। নিজের ঘর যদি নিজে সামলাতে না পারি, অন্য কেউ সামলিয়ে দেবে না।
যাযাদি/ এস