মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভোল পাল্টে রাজনীতিতে ফিরছে আওয়ামী লীগ

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৯ মে ২০২৫, ১৬:২৮
আপডেট  : ১৯ মে ২০২৫, ১৬:৪৪
ভোল পাল্টে রাজনীতিতে  ফিরছে আওয়ামী লীগ
ফাইল ফটো

আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সব কার্যক্রম সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও রাজনীতির মাঠে স্বক্রিয় হয়ে ওঠার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে পতিত এ দলটি। তাই ভোল পাল্টে দলের নেতাকর্মীরা কেউ সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক (এনসিপি), কিংবা বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে অনেকে জাদুকরী কারিশমা দেখিয়ে এসব দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে স্বক্রিয় থাকা অনেকে সম্প্রতি বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াতের ছোটখাটো পদ-পদবী বাগিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে রীতিমত আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছেন।

এদিকে ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশয় দেওয়ার জন্য বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকে দল থেকে বহিস্কার করা হলেও এখন প্রথম সারির একাধিক নেতা প্রকাশ্যেই তাদের রাজনৈতিক ঠাঁই দেওয়ার বলছেন। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন থাকা এনসিপিও এখন ‘ফ্যাসিস্ট’ আখ্যা দেওয়া এ দলটির নেতাকর্মীদের তাদের দলের সাদরে গ্রহণ করছে। আওয়ামী লীগের পদ-পদবীধারী বেশকিছু নেতার জামায়াতে যোগ দেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।

1

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলে ভেড়ানো নিয়ে বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াতের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যা সুষ্ঠ রাজনৈতিক ধারার জন্য উদ্বেগজনক। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন বিচ্ছিন্নভাবে পৃথক রাজনৈতিক দলে ঢুকলেও পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে কিছুটা খাপ খাইয়ে সময়-সুযোগ মত তারা ফের সংঘবদ্ধ হয়ে উঠবে। এ সময় তাদের আসল চেহারা প্রকাশ পাবে। তখন তাদের প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

অনেকের আশঙ্কা, মোটা অংকের কালো টাকার মালিক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিএনপি-জামায়াত বা এনসিপিতে যোগদান করলে তারা এসব দলকে গিলে খাবে। এসব দলের পোড়-খাওয়া এবং সর্বশান্ত নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের নব্য যোগ দেয়াদের ভিড়ে হারিয়ে যাবে অথবা অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে - যা এসব দলের মধ্যে ভীবিষিকাময় পরিস্থিতির তৈরি করবে।

এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোনো প্রকার বিচারের মুখোমুখি না হয়ে যদি বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিতে যোগদানের মাধ্যমে এবারের মতো মাফ পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে একসময় তারা এমন দানব হয়ে উঠবে যে জুলাই বিপ্লবের স্টেকহোল্ডারদের বেকায়দায় ফেলতে তাদের বেশি সময় লাগবে না এবং এই পথ ধরেই ফ্যাসিবাদ পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নতুনভাবে বাংলাদেশে গড়ে উঠবে। যেখানে জুলাই বিপ্লবে জড়িতদের একসময় বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।

প্রবীণ রাজনীতিকদের ধারণা, ৫ আগস্টের পর নানা প্রতিক‚লতায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অধিকাংশ নেতাকর্মীই এখন ঘরছাড়া। ভোল পাল্টে ভিন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এলাকায় ফিরে আসার পথ খুলছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের স্ব”ছ ইমেজের নেতাকর্মীরা দল বদলের খেলায় নামলেও পর্যায়ক্রমে অনেকেই এ সুযোগ নেবে। এ শ্রোতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্তরাও সহজেই ভিন্ন ব্যানারে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঢুকে পড়বে। শুধু ব্যক্তি স্বার্থে নিজ নিজ সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দল বদল করছে আপাত দৃষ্টিতে এমন মনে হলেও এটি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কৌশল হতে পারে বলেও মনে করেন অভিজ্ঞজনরা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বদলে বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক চাপ বা পরামর্শ উপেক্ষা করেই প্রাথমিক পর্যায়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে দলটি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে শেখ হাসিনার জায়গা পরিবর্তন না করার ব্যাপারে দলের নীতি-নির্ধারক সারির নেতা থেকে তৃণমূল কর্মী পর্যন্ত সবাই ছিলেন দৃঢ়চেতা। তবে ভয়াবহ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কয়েক মাস যেতেই খোদ দলীয় হাইকমান্ডই এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ঢাকায় তাদের দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নতুন নেতা খুঁজতে শুরু করে।

ভারত এবং পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ওই সময় একটি দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে জানান, ‘তাদের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনাসহ তারা অনেকেই এখন মনে করছেন, দেশের ভেতরে দলের মুখপাত্র বা নেতা প্রয়োজন, যিনি আত্মগোপনে না থেকে প্রকাশ্যে এসে বিপর্যস্ত নেতাকর্মীদের সংগঠিত করবেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর হাতে দলের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তাদের এ টার্গেট শুরুতেই ভেস্তে যায়। কেননা গ্রেপ্তার, মামলার ভয় ও প্রতিকুল পরিস্থিতিতে তাদের কেউ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার সাহস পাননি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা মূলতঃ ভোল পাল্টে বিভিন্ন দলে মিশে যাওয়ার কৌশল নিয়েছে। এরই ধারবাহিকতায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে যেভাবে যে দলের সঙ্গে পারছে, সে দলে ঢুকে পড়ছে। যা এখন প্রতিযোগিতায় রুপ নিয়েছে।

এদিকে বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপিও এখন কে কার আগে কাকে দলে ভেড়াতে পারে এ পাল্লায় নেমেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদেরর নিজ দলে আগেভাগে টানতে রীতিমত উঠেপড়ে লেগেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা জানান, আওয়ামী লীগের কারা কারা বিএনপিতে যোগ দিতে পারবে- তা নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। এ নিয়ে দলটির মধ্যম সারির নেতা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, বিএনপি গণমানুষের দল। এ দলের কোটি কোটি কর্মী-সমর্থক আছে। এই কর্মী-সমর্থকরাই দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে বিএনপির রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দল ভারী করার জন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বা অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের বিএনপিতে ঢোকানোর প্রয়োজন নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, অতিকথন সব সময়-ই খারাপ। বিএনপি এখন এমন অবস্থায় নেই যে, ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে হলেও আওয়ামী সমর্থকদের ডেকে ডেকে দলে ভেড়াতে হবে। বিএনপির জন্য কোটি কোটি মানুষ কাজ করেছে, তারাই বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হবে, নেতা হবে, নেতৃত্ব দেবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু দলে আওয়ামী লীগের কোন শ্রেণীর নেতাকর্মী প্রবেশ করতে পারবেন এ সম্পর্কে যে ক্রাইরেটিয়া দিয়েছেন তা অযৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।

তবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ দেওয়ার তথ্য সঠিক নয় দাবি করে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, এ বিষয়ে অনেকে ভুলভাল তথ্য ‍দিচ্ছেন। বিএনপি আগের অবস্থানেই আছে। এটা পরিবর্তন হয়নি। বিএনপিতে আওয়ামী লীগের কারও ঠাঁই হবে না। দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের এ ব্যাপারে কোনো সায় নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে